কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার নিয়ে দাপ্তরিক টানাটানি
কয়রা খুলনার অন্তর্গত হলেও বাঁধের কাজ পাউবো সাতক্ষীরা কার্যালয় থেকে করা হতো। এখন খুলনার অধীনে এলেও কিছু কাজ সাতক্ষীরায় রয়ে গেছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে থাকা খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার নিয়ে দাপ্তরিক জটিলতা কাটেনি। খুলনা ও সাতক্ষীরা—দুই জেলার পাউবোর কার্যালয়ের রশি টানাটানিতে দুর্ভোগে পড়ছেন কয়রার বাসিন্দারা। বিশেষ করে জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের প্রয়োজন দেখা দিলে তা করা সম্ভব হয় না। এতে বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
খুলনা জেলা শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবন ঘেঁষে অবস্থিত কয়রা উপজেলা। তিন দিকে নদীবেষ্টিত প্রত্যন্ত এ এলাকার নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীন ২টি পোল্ডারে ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ওই বাঁধের অধিকাংশই নাজুক। প্রতিবছর বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীর লোনাপানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হন কয়রার মানুষ। কয়রা উপজেলা খুলনা জেলার অন্তর্গত হলেও এর বেড়িবাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালিত হতো পাউবো সাতক্ষীরা কার্যালয় থেকে। এতে বাঁধের বিষয়ে যেকোনো জরুরি পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণের অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। এ ছাড়া বেশির ভাগ কাজ নিম্নমানের হয় বলে কয়রার বাসিন্দারা উপজেলার দুটি পোল্ডার খুলনা পাউবোর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৫ অক্টোবর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কয়রাকে পাউবো খুলনার নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের এক দাপ্তরিক আদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলীকে কয়রার বেড়িবাঁধের দায়িত্ব বুঝে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে সেই নির্দেশনার পর এখনো দাপ্তরিক ফাইলপত্র ও জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত কাগজপত্র সাতক্ষীরা পাউবো কার্যালয় থেকে পুরোপুরি বুঝে পায়নি বলে জানিয়েছে খুলনা পাউবো। খুলনা জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সাতক্ষীরা পাউবো থেকে দাপ্তরিক কাগজপত্রগুলো খুলনা পাউবোকে বুঝিয়ে দিতে দাপ্তরিক চিঠি দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সাতক্ষীরা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথাও বলেছি।’
আশরাফুল আলম আরও বলেন, কয়রার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীবেষ্টিত উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ১৪/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধ মজবুত করতে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল। সেটি হয় সাতক্ষীরা পাউবোর তত্ত্বাবধানে থাকাকালীন। পরে কয়রার সব বেড়িবাঁধ খুলনা পাউবোর আওতায় আসার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ওই প্রকল্পের কিছু কাজ খুলনা পাউবো এবং কিছু কাজ সাতক্ষীরা পাউবোকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছে। এ ছাড়া কয়রার বেড়িবাঁধ খুলনা পাউবোর আওতাধীন হলেও যে কাজগুলো সাতক্ষীরা পাউবো শুরু করেছিল, সেগুলো তাদেরই শেষ করতে বলা হয়েছে।
সাতক্ষীরা পাউবোর চলমান কাজের জন্য খুলনা পাউবোকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় জানিয়ে খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘কয়রার কোথাও হয়তো বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা ভাঙনকবলিত। সেখানে সাতক্ষীরা পাউবোর চলমান কাজ থাকলেও জেলা প্রশাসনের কাছে আমাদেরই কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য কিছুটা বিব্রতকর।’
বিষয়টি নিয়ে সাতক্ষীরা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধের যেসব কাজ আমরা শুরু করেছিলাম, সেগুলো আমরাই সম্পন্ন করছি। এখন খুলনা পাউবো যদি কোনো ক্ষেত্রে জটিলতার সম্মুখীন হয়, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের বলতে হবে।’
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, কয়রায় ১৪/১ ও ১৩-১৪/২ দুটি পোল্ডার রয়েছে। ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর ১৪/১ পোল্ডারের ৩১ দশমিক ৭৭৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মজবুত করে নির্মাণ করতে ১ হাজার ১৭২ কোটি ৩১ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। ওই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ৪৮টি গুচ্ছে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা পাউবোর আওতায় দেওয়া হয়েছে ২৫টি গুচ্ছের ২৩ দশমিক ৪৫০ কিলোমিটার (৭৪ শতাংশ) নির্মাণকাজ।
এ ছাড়া উপজেলার দুটি পোল্ডারে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে সাত কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের কাজ চলমান এবং আট কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের কাজ প্রস্তাবিত রয়েছে। এর সব কটিরই তত্ত্বাবধানে রয়েছে সাতক্ষীরা পাউবো।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাতক্ষীরা পাউবোর আওতায় কোনো কাজের জায়গায় আকস্মিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হলে জরুরি ভিত্তিতে কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাতক্ষীরা ও খুলনা পাউবোর মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। দাপ্তরিক জটিলতা কাটিয়ে পদক্ষেপের আগেই ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। যার কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে বিব্রত হতে হয়। দ্রুত মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাস্তবায়ন করে খুলনা পাউবোকে কয়রার বেড়িবাঁধের সব কার্যক্রম হস্তান্তর করতে আমরা উপজেলা পরিষদ থেকে রেজল্যুশন করে পাঠিয়েছি। আশা করছি, শুধু কাগজে–কলমে নয়, এবার বাস্তবেও কয়রার সব বেড়িবাঁধের দায়িত্ব খুলনা পাউবো পাবে।’