‘ছেলে আমাকে সেরা মায়ের সম্মান দিয়ে গেল’

ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গেছেন মা কহিনুর আক্তার। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকায়ছবি প্রথম আলো

‘আমার তো অনেক আশা ছিল। আমার ছেলে পড়ালেখা করে অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসবে। আমি সেরা মা হব। সে ইচ্ছা যে এভাবে ফলে যাবে, তা কে জানত। আমার বাবা যে এত বড় অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসবে, আমি তো বুঝতে পারি নাই। আমারে সে সেরা মায়ের সম্মান দিয়ে গেল।’

ছেলে ফয়সাল আহমেদকে (২০) হারিয়ে বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন মা কহিনুর আক্তার। নিজের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখন দিশাহারা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা গিয়েছিলেন নিহত ফয়সাল আহমেদের পরিবারের খোঁজ নিতে। তাঁদের সামনে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় সংঘর্ষে নিহত হন ফয়সাল আহমেদ। সেখান থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ফয়সালের শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল।

ফয়সাল ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ছেলেকে নিয়ে তাঁদের আশা ছিল অনেক। ভাবতেন, ছেলেটা জীবনে বড় কিছু হবে। তবে সে আশা ধুয়ে গেছে চোখের জলে। ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন কহিনুর আক্তার।

গতকাল সন্ধ্যায় নিহত ফয়সালের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যান বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, নগর পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলামসহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ ও সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি।

থামছে না মায়ের আর্তনাদ

রাসেল ও রাফিকে সামনে পেয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন কহিনুর আক্তার। চিৎকার করে বলছিলেন, কত আদরের ছিল তাঁর ফয়সাল। ছেলের অসুখ হলে সারা রাত দুশ্চিন্তায় কাটাতেন তিনি। রাত জেগে মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকলে বকাবকি করতেন ছেলেকে।

বারবার কহিনুরকে শান্ত করার চেষ্টা করা হলেও ছেলে হারানোর বেদনা যেন তাঁকে দিশাহারা করে দিয়েছে। অনবরত বিলাপ করছিলেন, ‘আমার মানিকরে কে গুলি করল? আমার মানিকরে কেউ আনি দাও না। আমার মানিকরে কে গুলি করল? ওরে আনি দাও না।’

ছেলের মৃত্যুর প্রায় ২৬ দিন পরও ছেলের জন্য আর্তনাদ থামেনি কহিনুরের। এখনো যেন ছেলেকে ফিরে পেতে চাইছেন তিনি। এ সময় কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আপনার ছেলেরা কথা দিচ্ছে, যারা আমাদের ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। আমরা সবাই এখন আপনার সন্তান।’

এ সময় অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আশ্বাস দেন বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনার। এ ছাড়া ফয়সালকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননার কথাও জানান তাঁরা।

টিউশনে গিয়েছিলেন ফয়সাল

চট্টগ্রাম নগরে ইপিজেড এলাকায় ঝনক প্লাজার পাশে সরু একটি গলি। গলি ধরে এগিয়ে গিয়ে ডান পাশে সড়ক থেকে নিচু আরেকটি গলি। কিছুদূর এগিয়ে গেলেই দুই কক্ষের ছোট একটি আধা পাকা বাসা। এই বাসায় মা ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ছোট বোন বৃষ্টিকে নিয়ে থাকতেন ফয়সাল।

ফয়সালের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে। ১৭ জুলাই সেখানেই দাফন করা হয় তাঁকে। তাঁর বাবা মো. জাকির হোসেন বরিশালেই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মা কহিনুর আক্তার একসময় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

দাফনের পর স্থানীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফয়সালের বাবা মো. জাকির হোসেন জানান, ফয়সাল সেদিন টিউশনে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। তাঁর শরীরে তিনটি গুলি লেগেছিল।