গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপির লোকজন বাড়িছাড়া, সেই সুযোগে হামলা-লুটপাট
গ্রেপ্তার আতঙ্কে প্রায় এক মাস ধরে বাড়িছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতা–কর্মীরা। ফলে তাঁদের বাড়িগুলো অনেকটাই পুরুষশূন্য। সেই সুযোগে তাঁদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে।
বিএনপির দলীয় সূত্র ও প্রথম আলোর হিসাবে, গত এক মাসে রূপগঞ্জে বিএনপির অন্তত ৩৪ জন নেতা–কর্মীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের তিন নেতা এবং গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে এক যুবদল নেতার কারখানায় কাজ করা দুই শ্রমিককে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন বলে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। বিএনপির অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা এসব হামলায় অংশ নিয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে, এমন কোনো হামলার কথা তারা জানে না।
হামলার ৩৪টি ঘটনার কোনোটিতেই থানায় অভিযোগ করেননি বিএনপির নেতা–কর্মীরা। কয়েকটি ঘটনার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে। তবে পরে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রায় এক মাসের মধ্যে বিএনপির শতাধিক নেতা–কর্মী ও তাঁদের স্বজনদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
চনপাড়ায় লুটপাট, অপহরণ
গ্রেপ্তার আতঙ্কে গত ২৭ অক্টোবর রাতে বাড়ি ছাড়েন চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র যুবদলের সহসভাপতি মো. আকরাম ও তাঁর ভাই বিএনপির নেতা মো. দুলাল। এরপর থেকে তাঁরা আর বাড়ি ফেরেননি। এর মধ্যে ২ নভেম্বর রাতে তাঁদের বাড়িতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে রামদা, চাপাতি ও চায়নিজ কুড়াল হাতে ২০-২৫ জনের একদল যুবক হামলা চালান। এ সময় বাড়ির সদস্যদের অস্ত্রের মুখে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে বাড়ির সব আসবাব, ২ লাখ টাকা, ৮ ভরি স্বর্ণালংকার ও ৩৬০ জোড়া কবুতর লুটে নেন তাঁরা। এসবের অর্থমূল্য অন্তত ৩৫ লাখ টাকা বলে পরিবারটির দাবি।
ঘটনার ১৯ দিন পর মঙ্গলবার সকালে চনপাড়ার ওই বাড়িতে গিয়ে বাড়ির লোকজন ও স্থানীয় অন্তত সাতজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়েছে। দোতলা বাড়িটিতে আকরামের স্ত্রী ও সন্তানেরা থাকেন। সংবাদকর্মী পরিচয়ে ২ নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আকরামের স্ত্রী হাত জোড় করে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
পরে সেদিনের ঘটনার বিষয়ে অন্তত সাতজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের ভাষ্য, হামলার সময় চনপাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখলেসুর রহমান, পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মো. শাওন ও মোহাম্মদ আলী সরাসরি লুটপাটে অংশ নিয়েছেন। চনপাড়া আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য শমসের আলী হামলার সময় একবার ঘটনাস্থলে এসে লুটপাটকারীদের নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। পরে তিনি সেখান থেকে চলে যান। তাঁর চলে যাওয়ার পর চনপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা ওই বাড়িতে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে গেলে ফের লুটপাট চলে। লুটপাটের সময় সাতটি ভ্যানে করে বাড়ির মালামাল নিয়ে যান লুটপাটকারীরা।
মঙ্গলবার বাড়িটির নিচতলার কক্ষে একটি নতুন খাট ও হাঁড়িপাতিল রাখার র্যাক দেখা যায়। বাড়ির দোতলায় উঠতে গেলে দেখা যায়, দুই সিঁড়ির মাঝখানে একটি কাঠের ওয়ার্ডরোব আটকে আছে। দোতলার কক্ষগুলোতে কোনো আসবাব দেখা যায়নি। কিছু কাপড় কক্ষের মেঝেতে পড়ে ছিল।
মুঠোফোনে যুবদল নেতা আকরাম বলেন, ২ নভেম্বর রাতে লুটপাটের সময় ওয়ার্ডরোবটি নামাতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় দুই সিঁড়ির মাঝখানে আটকে যায়। বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য না থাকায় ১৯ দিন ধরে সেভাবেই সেটি আটকে আছে। ২ নভেম্বর রাতে তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ কল করে পুলিশের সহায়তা চান। এর এক ঘণ্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়। পরিবারের ছয় সদস্যের ১৪ বছরের প্রবাসজীবনে আয় করা সবকিছুই সেই রাতে লুট হয়েছে বলে আকরামের দাবি। এমনকি তাঁর মেয়ের বিদ্যালয়ের ইউনিফর্মও লুটকারীরা নিয়ে গেছে।
চনপাড়া ঘুরে গত এক মাসে অন্তত ১১ নেতা–কর্মীর বাড়িতে লুট এবং তিন বিএনপি নেতাকে তুলে নিয়ে আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই তিন নেতা হলেন চনপাড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফারুক, ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আল আমিন ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি ওয়ালী উল্লাহ। এই তিনজনকে নিজের কার্যালয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ আছে শমসের আলীর বিরুদ্ধে। এর আগে ফারুকের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়।
শমসের আলী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যাঁদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের কথা বলা হচ্ছে, তিনি তাঁদের কাউকে চেনেন না। ২ নভেম্বর আকরামের বাড়িতে কী হয়েছে, তা তিনি জানেন না। এমনকি চনপাড়ায় কোনো লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি, বলে তাঁর দাবি। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, ‘মোখলেছুরের সঙ্গে আকরামের ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে। মোখলেছুর নিজের প্রভাব খাটিয়ে কিছু করলে করতে পারেন। সেটি আমি জানি না।'
ভুলতা-গোলাকান্দাইলে বেশি হামলা
রূপগঞ্জ ঘুরে দেখা গেল, উপজেলার ভুলতা ও গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি বিএনপি নেতা–কর্মীর বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এই গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ওমর হোসেনের কারখানায় কাজ করা দুই শ্রমিককে তুলে নিয়ে মারধরের পর মুক্তিপণ আদায় করা হয়। তাঁর মালিকানাধীন বরফ তৈরির কারখানায় তালা দেওয়া হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের জানানো হলে সোমবার ওমর হোসেনের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এ সময় তাঁর বাবা ও বোনকে মারধর করা হয়। পরে রাতে তাঁর বাড়ির সামনে থেকে ককটেলসদৃশ একটি বস্তু উদ্ধার করে পরিবারের লোকজন। ইউনিয়ন যুবলীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক কুরবান আলী এসব ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে ওমর অভিযোগ করেছেন।
৩ নভেম্বর একই ইউনিয়নের হোড়গাঁও এলাকায় একসঙ্গে যুবদল ও ছাত্রদলের সাত নেতার বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এ সময় ছাত্রদল নেতা মো. শুভর বৃদ্ধ মাকে ছুরিকাঘাত করে জখম করা হয়। শুভর বাড়িতে হামলার আগে করা একটি ভিডিওতে এলাকায় যুবলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত মো. মামুনের নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্রসহ ২৫-৩০ জনের একটি দলকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে শুভর বাড়িতে যেতে দেখা গেছে।
এ ছাড়া গত শনিবার রাতে ভুলতা পাড়াগাঁও এলাকায় জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি মোমেন মিয়া, সহসাংগঠনিক সম্পাদক নাবির হোসেন ও ভুলতা ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. সোহেলের বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সময় মোমেন মিয়ার বাড়ি থেকে ৬৫ হাজার টাকা এবং এক জোড়া সোনার কানের দুল লুট হয়।
এসব ঘটনাকে ডাকাতি বলে মন্তব্য করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তারা আওয়ামী লীগের লোকজন বলে ঘটনাগুলোকে ডাকাতি বলা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী প্রতিটি ঘটনা ডাকাতি। পুলিশের ভয়ে বিএনপির নেতা–কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আর এই সুযোগে আওয়ামী লীগের লোকজন বাড়িঘরে ডাকাতি করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তারা ডাকাতির সময় ব্যবহার করছেন। এসব ঘটনা পুলিশকে না জানানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সবই জানে। তারা কখনো কখনো ঘটনাস্থলেও যায়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফৌজদারি অপরাধ হলেও তারা নিজ থেকে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমরা থানায় গেলে উল্টো আমাদেরই গ্রেপ্তার করা হয়।’
‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগের বিষয়ে জানতে রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাঁরা ধরেননি। পরে তাঁদের মুঠোফোনে খুদে বার্তায় প্রশ্ন পাঠানো হলে সেই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দেননি।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, এসব হামলার বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এমন ঘটনা ঘটে থাকলে অবশ্যই তা অপরাধ। সে ক্ষেত্রে পুলিশকে জানানো হলে তারা ব্যবস্থা নেবে। গ্রেপ্তারের ভয়ে বিএনপি নেতারা নিজে না আসতে পারলে তাঁদের স্বজনদের থানায় গিয়ে অভিযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।