নামমাত্র খরচে মিলছে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, শোনার অনুভূতি পাচ্ছে বধির শিশুরা

সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জন্মবধির শিশুর কানে ইমপ্ল্যান্ট অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা আছে। গত বুধবার তোলাছবি: প্রথম আলো

এক দশক আগেও দেশে বধিরতায় ভোগা মানুষের জন্য ‘কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট’ চিকিৎসা প্রচলিত ছিল না। অনেকে তখন বিদেশে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় এ চিকিৎসা করাতেন। এখন অবশ্য দেশেই ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় তা সম্ভব। তবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের আটটি হাসপাতালে নামমাত্র টাকায় এ চিকিৎসা করা যাচ্ছে।

সিলেটে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট চিকিৎসা করা হয় এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২০২২ সালের ২৫ মে থেকে সিলেটে এ চিকিৎসা শুরু হয়। এর ফলে সিলেটের সম্পূর্ণ শ্রবণপ্রতিবন্ধী বা জন্মগত মূক ও বধির শিশুরা এখন কানেও শুনছে, কথাও বলছে। গত বুধবার হাসপাতালে শততম শিশু হিসেবে তিন বছর সাত মাস বয়সী মুনতাহার কানে ইমপ্ল্যান্ট অস্ত্রোপচার করা হয়।

হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান নূরুল হুদা নাঈম প্রথম আলোকে বলেন, কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হচ্ছে একটি আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি। দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর কানে ইলেকট্রনিক ডিভাইস লাগিয়ে এ চিকিৎসা করে থাকেন।

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ৬০০ শিশু বধির হয়ে জন্ম নেয় উল্লেখ করে চিকিৎসক নূরুল হুদা আরও বলেন, সিলেটে এই চিকিৎসাব্যবস্থা চালু হওয়ায় জন্ম থেকে কানে না শোনা এবং কথা বলতে না পারা শিশুদের চিকিৎসায় একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শব্দ শুনতে সহায়তা করে। এটা বায়োনিক কান নামেও পরিচিত। এটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অন্তঃকর্ণের কক্লিয়ায় স্থাপন করা হয়। এর দুটি অংশ। বাইরের অংশে মাইক্রোফোন, স্পিস প্রসেসর ও ট্রান্সমিটার কয়েল থাকে। ভেতরের অংশে রিসিভার স্টিমুলেটর ও ইলেকট্রেড থাকে।

যেভাবে শুরু হলো

ওসমানী হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের চিকিৎককেরা জানিয়েছেন, জন্ম থেকে পাঁচ বছর বয়সী যেসব শিশু বধিরতায় ভোগে, তাদের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করার প্রয়োজন পড়ে। শুরুতে কেবল ঢাকাতেই এ চিকিৎসা হতো। ঢাকার বাইরে সিলেট ও চট্টগ্রামে সরকারিভাবে এমন চিকিৎসা চালুর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়ন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সিলেটে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। পরে ২০২২ সালের ২৫ মে থেকে সিলেটে এ চিকিৎসা শুরু হয়। সিলেটে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্মসূচি পরিচালক ছিলেন চিকিৎসক নূরুল হুদা।

প্রকল্প বাস্তবায়ন–সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনুদানে ২০১০ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডেভেলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট’ কর্মসূচি চলছে। এরপর পর্যায়ক্রমে ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। এ ছাড়া এখন চট্টগ্রাম সিএমএইচ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একই চিকিৎসা চলছে। এর বাইরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই চিকিৎসা চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

ওসমানী হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নাক, কান ও গলা বিভাগের অধীনে আলাদা একটা ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে অস্ত্রোপচার কক্ষ। যেসব শিশুর বধিরতা আছে, তাদের অভিভাবকেরা হাসপাতালে নাম নিবন্ধন করাতে পারবেন। পরে গরিব ও নির্বাচিত শিশুদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এ চিকিৎসা দেওয়া হয়।

শততম কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শেষে চিকিৎসক দলের সদস্যরা। বুধবার এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

নিবন্ধন করে নামমাত্র খরচে সেবা

ইমপ্ল্যান্ট ইউনিটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অস্ত্রোপচারের জন্য ওসমানী হাসপাতালের নতুন বহির্বিভাগের দশম তলায় কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কার্যক্রমের কার্যালয়ে একটি নির্ধারিত ফরম পূরণ করতে হয়। সেখানে শিশুর অভিভাবকের বার্ষিক আয় উল্লেখ থাকে। পরবর্তী সময়ে রোগী নির্ধারণের জন্য চিকিৎসকেরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত রোগীদের প্রথম ধাপে সিটি স্ক্যান, এমআরআইসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে অস্ত্রোপচারের উপযোগী কি না, সেটা নির্ধারণ করা হয়। পরে যারা অস্ত্রোপচারের উপযোগী, তাদের নাম বরাদ্দ কমিটিতে পাঠানো হয়। সে কমিটি চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের নাম জানায় এবং পর্যায়ক্রমে অস্ত্রোপচারের জন্য ডাকা হয়।

আরও পড়ুন

একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যাদের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়, তাদের অভিভাবকের বার্ষিক আয়ের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিভেদে ১৫ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। এরপরই সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হয়। এ সময় একেকজন রোগীকে বিনা মূল্যে গড়ে ৮ থেকে ১২ লাখ টাকার ডিভাইস লাগানো হয়। তবে দুজন ছাড়া ওসমানী হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা রোগীর অভিভাবকের আয়ের ভিত্তিতে ১৫ হাজার টাকা করে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে সেবা পেয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পাঁচ বছরের কম বয়সী জন্মবধির শিশু এবং পাঁচ বছরের ওপরে যারা কোনো কারণে কানে কম শোনেন এমন রোগীদের চিকিৎসাই ওসমানীতে হয়ে থাকে। অস্ত্রোপচার শেষে একেকজন রোগীকে হাসপাতালে কমপক্ষে এক বছর নিয়মিতভাবে অডিও ভারবাল থেরাপি দিতে হয়। এরপরই মূলত একজন রোগী পরিপূর্ণভাবে শুনতে ও কথা বলতে পারেন। যদিও অস্ত্রোপচারের এক মাস পর ডিভাইসের সুইচ অন করে দেওয়া হয়, তখন রোগী শুনতে শুরু করেন।

কানেও শুনছে, কথাও বলছে তারা

ওসমানী হাসপাতালের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গত বুধবার হাসপাতালে জন্মবধির এক শিশুর কানে শততম ইমপ্ল্যান্ট অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিন বছর সাত মাস বয়সী শিশু মুনতাহার অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে হাসপাতালটি এ মাইলফলক অর্জন করেছে।

শিশু মুনতাহার বাড়ি মৌলভীবাজারের সদর উপজেলার আজিজরগাঁও গ্রামে। তার বাবার নাম মাসুদুর রহমান। সফলভাবে মুনতাহার অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেন হাসপাতালের নাক, কান, গলা ও হেড নেক সার্জারি বিভাগের প্রধান নূরুল হুদা। সার্জারি দলে অন্য চিকিৎসকদের মধ্যে ছিলেন জহিরুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম, টি এম ইমরান আহমদ, এনামুল ইসলাম, ময়নুল ইসলাম, মো. শহীদউল্লাহ প্রমুখ।

শিশু আদৃকা রায়ের অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে ওসমানী হাসপাতালে এ চিকিৎসার সূচনা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার রাতে কথা হয় আদৃকার মা সঞ্চিতা রায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, এখন তাঁর মেয়ের বয়স ছয়। গত ১৪ ডিসেম্বর তাঁরা সপরিবারে ফ্রান্সপ্রবাসী হয়েছেন। তাঁর মেয়ে জন্মবধির ছিল। কথাও বলতে পারত না, কানেও শুনত না। ওসমানী হাসপাতালে সফল চিকিৎসার পর তাঁর মেয়ে কথাও বলছে, কানেও শুনছে।

শিশুদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্করাও হাসপাতাল থেকে এই সেবা নিয়েছেন। সুনামগঞ্জের ছাতকের নরসিংপুর গ্রামের আজাদ মিয়া (২৭) তাঁদের একজন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ১৭ বছর বয়সের সময় তিনি হঠাৎ করেই দুই কানে কম শুনতে থাকেন। ওসমানী হাসপাতালে তিনিও সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা নেন। এখন তিনি পরিপূর্ণভাবে শুনতে পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন