নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ১৭৫ জন নিখোঁজ আছেন বলে দাবি করেছেন স্বজনেরা। গাজী টায়ার্স কর্তৃপক্ষ বলছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় কারখানার কোনো শ্রমিক নেই। ফলে নিখোঁজ ব্যক্তিরা কেন কারখানায় এসেছিলেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
উত্তর খুঁজতে গতকাল সোমবার সকাল থেকে আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কারখানা কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে।
স্বজনসহ অধিকাংশই বলেছেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই কারখানায় লুটপাট করতে এসেছিলেন। কেউ কেউ স্বজনদের খোঁজে বা ঘটনা দেখতে কারখানায় ঢুকেছিলেন।
কারখানার পোড়া ভবনের সামনে বসে কাঁদছিলেন পাশের মুড়াপাড়া এলাকার এক নারী। কোলে তাঁর দুই বছরের সন্তান। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। কারখানায় লুটপাট শুরুর খবর শুনে গত রোববার বিকেলে কারখানায় আসেন। রাত ৯টার সময় স্বামীর সঙ্গে মুঠোফোনে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়। তখন তিনি কারখানার ভেতরে ছিলেন। এরপর আর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কারখানায় আসার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘লুটপাট করতে আইছিল। তার আগেও তো নিছে। তহন কোনো সমস্যা হয় নাই।’
ওই নারীর মতো নিখোঁজ ব্যক্তিদের অন্তত চারজন স্বজন লুটপাট করতে আসার বিষয়টি স্বীকার করেন। তাঁরা জানান, সরকার পতনের পর রূপগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার্স ও গাজী পাইপ কারখানায় লুটপাটের পর আগুন দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট শুরু হওয়া লুটপাট শেষ হয় ৮ আগস্ট। এতে রূপগঞ্জের কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর রোববার গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে দ্বিতীয় দফায় আবার বিভিন্ন গ্রামের লোকজন লুটপাটে জড়ান। অন্যদের দেখাদেখি নিখোঁজ ব্যক্তিরা লুটপাট করতে কারখানায় এসেছিলেন।
মইকুলী এলাকার এক জামদানি কারিগর ভাইয়ের খোঁজে কারখানায় এসেছেন। আজ সকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পর তাঁর গ্রামের অনেকেই কারখানায় লুটপাট করেছেন। তাঁর ২০ বছর বয়সী ভাইয়ের বন্ধুও লুটপাটকারীদের একজন। রোববার লুটপাটের খবর জানার পর সেই বন্ধুর সঙ্গে তাঁর ভাই বিকেলে কারখানায় আসেন। তারপর থেকে দুজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
৩৮ বছর বয়সী এই জামদানি কারিগর বলেন, প্রথমবার লুটপাটের পর কোনো আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়ায় গ্রামের লোকজন বিষয়টিকে অপরাধ মনে করেননি। ৫ আগস্টের পর লুটপাটকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে রোববার কেউ লুটপাটের সাহস পেতেন না।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে গাজী টায়ার্সের কোনো শ্রমিক নেই বলে দাবি করেছেন কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫ থেকে ৮ আগস্ট কারখানায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তার পর থেকে কারখানার উৎপাদন বন্ধ। রোববার লুটপাট শুরুর সময় কারখানায় কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মকর্তা ছিলেন। মাইকে ঘোষণার পর লুটপাটকারী ব্যক্তিরা কারখানায় ঢুকতে শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন তাঁরা কারখানার বাইরে চলে যান।
সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, লুটপাটের একপর্যায়ে লুটপাটকারী দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। রাত ৯টা নাগাদ কাঁচামালের গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত ছয়তলা ভবনে লুটপাট চলতে থাকে। এরই মধ্যে কে বা কারা ভবনের নিচতলায় আগুন দেয়। তখন লুটপাটকারী ব্যক্তিদের একটি অংশ ভবনে আটকে পড়ে বলে তাঁরা শুনেছেন।
হামলার ঘটনার পর পুলিশের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লুটপাট শুরুর পর থানাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছি। পুলিশ আসেনি। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল কারখানার ফটকের সামনে আসে। কিন্তু ১০ মিনিটের বেশি দাঁড়ায়নি। রাতে আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস আসে। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে এমন নিখোঁজের ঘটনা ঘটত না।’
ঘটনার অন্তত ২০ জন প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে বলেন, ছয়তলা ভবনে লুটপাটের সময় নিচতলায় আগুন দেওয়া হয়। ভবনের ভেতর যাঁরা ছিলেন, তাঁরা লুটপাটের জন্য বা পরিস্থিতি দেখতে ভবনের ভেতরে ঢুকেছিলেন। আগুন দেওয়ার পৌনে তিন ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস যায়। তার আগে ভবনে আটকে পড়া লোকজনের কেউ কেউ ভবনের ছাদ থেকে তাঁদের বাঁচাতে চিৎকার করেন। এ সময় কারখানার নিচে থাকা খাদুন এলাকার বাসিন্দা রতন খান পাইপ বেয়ে ছাদের ওপরে উঠে একটি রশি দেন। সেই রশি বেয়ে তখন অনেকেই নিচে নেমে আসেন।
রতন খান প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিসংযোগের পর ওপরে অসংখ্য মানুষ আটকে পড়েছিলেন। রাত ১২টা নাগাদ তাঁরা চিৎকার করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠেন। রতনের দাবি, ভবনে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই লুটপাটের জন্য গিয়েছিলেন। কেউ কেউ আগুন লাগার পর ভবনের ভেতরে থাকা স্বজনদের নামিয়ে আনতে ওপরে ওঠেন।
আজ দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বজনেরা অনেকে নিখোঁজের বিষয় জানাচ্ছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগুনের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।