অযত্নে ভাষাশহীদদের স্মৃতিচিহ্ন 

ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতি ধরে রাখতে নিজ নিজ এলাকায় গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলো পড়ে আছে অবহেলায়।

ভাষা‌সৈ‌নিক আবদুল জব্বা‌রের স্মর‌ণে নির্মিত শহীদ মিনারটিতে যাতায়া‌তের কোনো রাস্তা নেই। গতকাল ময়মন‌সিং‌হের হালুয়াঘাট উপ‌জেলার শিমুলকু‌চি গ্রামেছবি: প্রথম আলো

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এ জাতির এক চিরজাগরূক চেতনা। বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছিলেন, ১৯৫২ সালে জীবন দিয়েছিলেন, সেই আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের রক্তে লেখা বাঙালির আত্মপরিচয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একুশের লড়াই দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

ভাষাশহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন—আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। ২০০০ সালে তাঁদের রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। যদিও প্রকৃত শহীদের সংখ্যা আরও অনেক।

ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতি ধরে রাখতে সারা বছর তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে নিজ নিজ এলাকায় যেসব স্থাপনা হয়েছিল, সেসবও পড়ে আছে অবহেলায়।

মানিকগঞ্জে শহীদ রফিক গ্রন্থাগার বেহাল

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল নওয়াধা গ্রামের সন্তান ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। গ্রামটির নাম এখন রফিকনগর। রফিকের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৭ বছর আগে এ গ্রামে তাঁর নামানুসারে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। জাদুঘরে আছে ভাষাশহীদের ব্যবহৃত লুঙ্গি, পাঞ্জাবিসহ তাঁর ব্যবহৃত বেশ কিছু স্মৃতিচিহ্ন। অবহেলায় পড়ে আছে এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর।

গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, বছরজুড়ে সুনসান নীরবতা, ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় গণমাধ্যমকর্মী ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আনাগোনা। ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারির নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 

২০০৮ সালে ভাষাশহীদের বাড়ির অদূরে লে. কর্নেল (অব.) মজিবুল ইসলাম খানের দান করা ৪৫ শতক জমিতে ‘ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণ করে জেলা পরিষদ। এতে ব্যয় হয় ৮০ লাখ টাকা। এর আগে ২০০০ সালে ভাষাশহীদ রফিকের পৈতৃক ভিটায় একটি ঘর তৈরি করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র। ২০১৬ সালে বাড়ির আঙিনায় শহীদ মিনার নির্মাণ করে জেলা পরিষদ।

একতলা ভবনের গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে ভেতরে ঢুকতেই বড় একটি হলরুম। সেখানে দেয়ালে টাঙানো রফিকসহ ভাষাশহীদদের ছবি। দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা আলমারিতে সাজানো বই। গ্রন্থাগারিক ফরহাদ হোসেন বলেন, গ্রন্থাগারে ১৭টি আলমারিতে ১৫ হাজারের বেশি বই রয়েছে। বছরজুড়ে গ্রন্থাগারটি খোলা রাখা হলেও পাঠকের আনাগোনা তেমন থাকে না। প্রায় চার বছর ধরে দৈনিক পত্রিকা না থাকায় সাধারণ পাঠকও নেই।

ভাষাশহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি গ্রন্থাগার ও জাদুঘরের ভেঙে পড়া আলমারি। সম্প্রতি ফেনীর দাগনভূঞায়
ছবি: সংগৃহীত

ফেনীর শহীদ সালাম জাদুঘর

ভাষাশহীদ আবদুস সালামের গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায়। ১৭ বছর আগে তাঁর নিজ গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘সালামনগর’। সে বছরই নির্মিত হয় ‘ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’। বছরের ১১ মাস কেউ খবর না রাখলেও ফেব্রুয়ারি এলে এই জাদুঘরের কদর বাড়ে।

গ্রন্থাগারের সামনে নির্মিত শহীদ মিনারে একুশের প্রভাতফেরিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ। গ্রন্থাগারের কয়েকটি আলমারিতে পুরোনো কিছু বই থাকলেও অনেক বই নষ্ট হয়ে গেছে। কথা বলে জানা গেল, গত বছরের আগস্ট মাসের বন্যায় গ্রন্থাগারের এসব বই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয় আলমারিসহ আসবাব।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে ফেনী জেলা পরিষদ থেকে মাস্টাররোলে একজন গ্রন্থাগারিক ও তত্ত্বাবধায়ক দায়িত্ব পালন করছেন। জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাগারটি হওয়ায় নিয়মিত কোনো পাঠক নেই। বছরের প্রায় সময় গ্রন্থাগারটি বন্ধ থাকে।

গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বে থাকা লুৎফুর রহমান বলেন, বন্যার সময় বই ও তাক ডুবে গেলে পরে রোদে শুকিয়ে বই কিছুটা পাঠযোগ্য করা হয়। তবে তাক ও আলমারি নষ্ট হওয়ায় বইগুলো টেবিলের ওপর বিছিয়ে রাখতে হয়েছে।

হালুয়াঘাট ও গফরগাঁওয়ে শহীদ জব্বারের স্মৃতি পড়ে আছে অযত্নে

আবদুল জব্বারের জন্মস্থান ময়মনসিংহের গফরগাঁও। তবে ১৯৫০ সালের শেষ দিকে তিনি সপরিবার হালুয়াঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী শিমুলকুচি গ্রামে চলে আসেন। তখন তিনি আনসার বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। শিমুলকুচি গ্রামে এখন অযত্নে পড়ে আছে ভাষাশহীদ জব্বারের নামে করা শহীদ মিনার, তাঁর মা, স্ত্রীর সমাধিস্থলসহ সব স্থাপনা। আবদুল জব্বারের নামে করা শহীদ মিনার বেদিতে যাতায়াতে নেই কোনো সড়ক। ধানখেতের আল ধরে যেতে হয়।

এলাকাবাসী ও ভাষাশহীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৭ সালে আবদুল জব্বারের ভাতিজা আতিক উল্লাহর দেওয়া ১ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় ‘ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার ফাউন্ডেশন’। ২০১০ সালে এই ফাউন্ডেশন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন পায়। তখন থেকে একটি টিনের ঘরে ফাউন্ডেশনের কাজ চলত। পরে সেই ঘরটি ঝড়ে ভেঙে পড়ার পর আর সংস্কার করা হয়নি। তাঁর একমাত্র ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম একটি শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য জেলা পরিষদে আবেদন করেন। ২০১০ সালে জেলা পরিষদ একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেয়। সংস্কার না করায় সেই শহীদ মিনারটি এখন জরাজীর্ণ।

ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও তাঁর ভাতিজা আতিক উল্লাহ বলেন, ফাউন্ডেশনের ঘরটি ভেঙে পড়েছে। যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই।

গফরগাঁওয়ে ভালুকা-গফরগাঁও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাঁচুয়া মোড়ে রয়েছে কংক্রিটের একটি তোরণ। সেখানে লেখা ‘ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার নগর’। এই তোরণ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সরু সড়ক ধরে এগোলেই দেখা মেলে ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের। ২০০৮ সালে আবদুল জব্বারের স্মৃতি রক্ষায় ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ এটি বাস্তবায়ন করে।

গ্রন্থাগারিক মো. কায়সারুজ্জামান বলেন, ‘দর্শনার্থীরা জাদুঘরে ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখতে চান। কিন্তু সংরক্ষণে না থাকায় আমরা তা প্রদর্শন করতে পারি না।’

পঞ্চগড়ে ভাষাসৈনিক সুলতানের নামে হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ

পঞ্চগড়ের সন্তান মোহাম্মদ সুলতান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। এই ভাষাসৈনিক এখন পর্যন্ত পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় পদক। তবে তাঁর মৃত্যুর ২৮ বছর পর ২০১১ সালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল। এ সময় বোদা উপজেলা শহর থেকে মাড়েয়া পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার সড়কের নামকরণ করা হয় ‘ভাষাসৈনিক সুলতান সড়ক’। একই সময়ে তাঁর একটি ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার সিদ্ধান্ত হলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

গাইবান্ধায় ভাষাসৈনিক কার্জন আলী পাঠাগার

গাইবান্ধা সদরের দারিয়াপুর বাজারের তিনমাথা মোড়ে প্রায় ৩০ বছর আগে ভাষাসৈনিক কার্জন আলীর নামে গড়ে উঠেছিল ‘ভাষাসৈনিক কার্জন আলী পাঠাগার’। কিন্তু পাঠাগারটি এখন বেহাল। প্রয়োজনীয় বই নেই। নেই অবকাঠামো। পাঠাগারটি ভাড়া ঘরে ধুঁকে ধুঁকে চলছে।

পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ বলেন, পাঠক থাকলেও আর্থিক সমস্যার কারণে প্রয়োজনীয় আসবাব কেনা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ পাওয়া বইও সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। পুরোনো বই দিয়ে পাঠাগার চালানো হচ্ছে। ফলে এ প্রজন্মের পাঠকেরা পাঠাগারে আসতে চান না।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ; প্রতিনিধি, মানিকগঞ্জ, নালিতাবাড়ী, পঞ্চগড় গাইবান্ধা; সংবাদদাতা, ফেনী]