অভাবের সংসারে স্বামী মারা যাওয়ার পর চার সন্তান নিয়ে অথই সাগরে পড়েন জ্যোৎস্না আক্তার। গার্মেন্টসে চাকরি করে সন্তানদের কিছুদূর পড়ান। কিন্তু কিছুদিন বাদে পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরেন তাঁর দুই ছেলে জহিরুল ইসলাম (২৬) ও রবিউল ইসলাম (২২)। কিন্তু এই রবিউলই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। গত ১৯ জুলাই বড় ভাইকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করে তিনি নিজেই আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ছেলের মৃত্যুতে জ্যোৎস্না আক্তার এখন দিশাহারা।
রবিউলের পৈতৃক বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার নাওগাঁও ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামে। তাঁর বাবা আবদুর রাজ্জাক রিকশাচালক ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি মারা যান। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন রবিউল। ২০১৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুল ছাড়তে হয় রবিউলকে। তিনি উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের সরকার মার্কেট এলাকার একটি বাসায় কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) কাম প্রহরী হিসেবে কাজে যোগ দেন। তাঁর বড় ভাই জহিরুল ইসলাম গাজীপুরে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। রবিউল আর লেখাপড়া করেননি। তবে জহিরুল কারখানার কাজের পাশাপাশি ২০২০ সালে এসএসসি পাস করেন। যদিও এরপর আর পড়ালেখা এগিয়ে নিতে পারেননি। ছোট দুই বোনকে বিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি জহিরুল বিয়ে করেছেন। রবিউলের জন্য কনে দেখা চলছিল।
স্বজনেরা জানান, ১৯ জুলাই বিকেলে উত্তরা আজমপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন রবিউল। রবিউলের ডান কানের কাছ দিয়ে একটি গুলি লেগে মাথা ভেদ করে। আরেকটি গুলি মাথায় আটকে ছিল। তাঁকে প্রথমে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেই বাড়ির মালিককে খবর পাঠানো হয়। পরে আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ২০ জুলাই ভর্তি করা হলে ২২ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩ জুলাই ময়নাতদন্ত শেষে সেদিনই নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।
জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অভাবের সংসার। রবিউল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসার আমাদের দুই ভাইয়ের কাঁধে এসে পড়ে। বাবা জমিজমাও রেখে যাননি। এরপর দুই ভাই সংসারের হাল ধরি।’ তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার। জুমার আগে আমাকে ফোন করেছিল রবিউল। বলেছিল উত্তরার দিকে অনেক গন্ডগোল, বাইরে যেন বের না হই। কিন্তু সেদিন রাত ১১টার দিকে আমরা খবর পাই, রবিউল গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরদিন আগারগাঁও নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে যাওয়ার পথে মিরপুর–১০ নম্বর এলাকায় আমি নিজেও গোলাগুলির মুখে পড়ি। হাসপাতালে গিয়ে আইসিইউতে পাই ছোট ভাইকে। তাকে বাঁচানো যায়নি।’
জহিরুল বলেন, ‘আমরা জানতাম না সে আন্দোলনে যাচ্ছে। আমাকে নিষেধ করে সে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেহেতু আমার ভাই মারা গেছে, তাকে যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। আমরা একসময় ছাত্র ছিলাম। খারাপ লেগেছে ছাত্রদের মৃত্যু দেখে। এই খারাপ লাগা থেকেই হয়তো রবিউল আন্দোলনে যায়। আমাদের পরিবারের চাওয়া, ভাই যেন শহীদের মর্যাদা পায়। টাকাপয়সা কিছুই চাই না। সে আন্দোলনে মারা গেছে, তার নামটা যেন তালিকায় থাকে।’
জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘ছোট ভাইকে বিয়ে করাইনি, কথা চলছিল। সে বলত, আমাদের আর কষ্ট থাকবে না। কাজের (কেয়ারটেকার) পাশাপাশি গাড়ি চালানো শিখেছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষাও দিয়েছে। আম্মাকে ও আমাকে বলত যেন চিন্তা না করি। আমাদের অভাব আর থাকবে না বলত। কিন্তু অভাব রয়ে গেল, সে নিজেই (রবিউল) চলে গেল।’
রবিউল ইসলাম মারা যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন মা জ্যোৎস্না আক্তার। সাত দিন স্যালাইন পুশ করে রাখা হয়। ছেলের কবরের পাশে গিয়ে কাঁদেন তিনি। জ্যোৎস্না আক্তার বলেন, ‘শেখ হাসিনার লোকজনের গুলিতে আমার ছেলে মারা গেছে। শেখ হাসিনা কেন এমন গুলির অর্ডার দিল? এমন কইর্যা আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। আমি বিচার চাই, আর কিছুই চাই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ছেলেই আশা-ভরসা ছিল। গাড়ি চালিয়ে আমাদের সংসার ভালো করে চলবে বলত। কিন্তু ছেলের মনের আশা পূরণ করে যাইবার পারল না।’