বিশেষ অলিম্পিকের স্বর্ণপদকে সংসারের অভাব ঘোচেনি ইমনাদের

বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জেতা মেডেল হাতে ইমনা খাতুন। মাগুরার শালিখা উপজেলার মধুখালী গ্রামেছবি: প্রথম আলো

ইমনা খাতুনের বয়স যখন তিন বছর। এক দিন আগুনে তাঁর শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঝলসে যায়। মা–বাবা তাঁর বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। সে ধাক্কায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতা তাঁর সঙ্গী হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে ২০২৩ সালে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশেষ (স্পেশাল) অলিম্পিকে ৪০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জিতে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনেন ইমনা।

ইমনা খাতুনের (১৭) বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামে। পেশায় কৃষক বাবা বাশারুল বিশ্বাস পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। মা শাহানারা খাতুন গৃহিণী। ছয় ভাই–বোনের মধ্যে ইমনা ছাড়াও তাঁর ছোট এক ভাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। অভাবের সঙ্গে নিত্য লড়াই করা এই পরিবারকে আশার আলো দেখিয়েছেন ইমনা। এমন সাফল্য পাওয়ার পর ইমনা খাতুনও ভেবেছিলেন তাঁর ভাগ্য বদলে যাবে। তবে বদলায়নি তেমন কিছুই। উল্টো তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের মুখে এখন হতাশার সুর।

২০১৯ সালে পাশের গ্রাম পুলুম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়ে পড়ার সময় দৌড়, লাফসহ বিভিন্ন খেলায় যুক্ত হন তিনি। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদ সুমন ইমনাদের অনুশীলন করাতেন। এরপর খুলনা ও ঢাকায় বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিয়ে ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে সুযোগ পান ২০২৩ সালে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের নিয়ে আয়োজন করা বার্লিন স্পেশাল অলিম্পিকে। সেখানে ৪০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জিতে বাজিমাত করেন ইমনা। তাঁকে নিয়ে এখন গর্ব করেন এলাকার লোকজন।

বার্লিন বিশেষ অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জেতার পর ইমনা খাতুন
ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

গত শনিবার বাড়িতে কথা হয় ইমনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। মা শাহানারা খাতুন বলেন, ‘আমার আরও একটা ছেলে প্রতিবন্ধী। একজনের ইনকামে অনেক কষ্টে চলে সংসার। মেয়ে অলিম্পিকে মেডেল জিতার পর অনেকে এসে অনেক স্বপ্ন দেখাল, কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। মেডেলগুলো সাজায় রাখার জায়গাও নেই ঘরে’। তিনি জানান, বিভিন্ন খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য যাতায়াত ভাড়া ছাড়া অতিরিক্ত কোনো অর্থ দেওয়া হয় না। যাতায়াত ভাড়া যা পাওয়া যায়, খরচ হয় তার চেয়ে বেশি।

ছয় ভাই–বোনের মধ্যে এক বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট টিনের চালার দুটি ঘরে সাত সদস্যের পরিবারের বসবাস। হতাশার সুর ইমনা খাতুনের মুখেও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘শুনিছি খেলা করলি, অলিম্পিকে গেলি অনেক টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই তো হলো না। এখন অনেকে সম্মান দেন। কিন্তু সম্মান আর মেডেল দিয়ে তো অভাব দূর হয় না।’

আরও পড়ুন

পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইমনা অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের পর তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঙ্গারামপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৩০ হাজার টাকা দেয়। এ ছাড়া মাগুরা ২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারের পক্ষ থেকে ৩৫ হাজার টাকা অর্থসহায়তা পায় ইমনার পরিবার। পাশাপাশি চলতি বছর মাগুরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সম্মাননা দেওয়া হয়। তবে সেখানে নগদ কোনো অর্থ ছিল না।

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে হতাশা থাকলেও হাল ছাড়তে চান না গঙ্গারামপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমনা খাতুন। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা চালিয়ে যেতে চান তিনি। ইমনা বলেন, ‘আরও দুইবার অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পাব। এ জন্য নিয়মিত অনুশীলন করছি। সামনেও জেতার চেষ্টা করব। এর সঙ্গে একটা সরকারি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করব। যাতে চাকরি করে বাবার সহযোগিতা করতে পারি।’

স্পেশাল অলিম্পিকে অ্যাথলেট দলের কোচ হিসেবে ইমনাদের সঙ্গে ছিলেন মো. সামসুল আরেফিন। তিনি ইমনাদের গ্রামের বাড়িও ঘুরে গেছেন। এই কোচ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৩ সালে স্পেশাল অলিম্পিকে পদকজয়ীদের দেশে ফেরার পর খেলোয়াড়দের অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। আর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটা সংবর্ধনা দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা হয়নি।

সামসুল আরেফিন বলেন, ‘নিয়মিত অলিম্পিকে যদি কেউ পদক জেতে তাঁরা সরকারি–বেসরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে একধরনের অবহেলা লক্ষ করা যায়। তাঁরা পদক জিতে আসার পর কিছুই করা হয় না। যদিও এসব শিশুদের দিকেই সবার বেশি নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করি।’