শরীয়তপুরের নড়িয়া-জাজিরা সড়কের কীর্তিনাশা নদীতে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় এলাকার লোকজন দুর্ভোগে পড়েছে। সাত বছরে দুই দফায় ঠিকাদার পরিবর্তন করেও সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। পুরোনো সেতুটিও ভেঙে ফেলায় ছয় মাস ধরে ওই পথে চলাচলকারীদের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে নদী পারাপার হতে হচ্ছে।
সেতুটির নাম ভাষাসৈনিক গোলাম মাওলা সেতু। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ এ পথ দিয়ে চলাচল করে। সামনে বর্ষা। নদীতে পানি বেড়ে বর্ষায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে। যাঁরা ট্রলারে করে নদী পার হতে চান না, তাঁদের ১৫ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ ঘুরে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে হয়।
৩ জুন নড়িয়া কীর্তিনাশা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, কোনো শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন না। নদীর পূর্ব পাড়ে ভায়াডাক্টের কিছু অংশ নির্মাণ করা হয়েছে, আর পশ্চিম তীর ও নদীতে আটটি পিলার করা হয়েছে। ওই পথে চলাচলকারী ব্যক্তিরা ট্রলার দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন। ট্রলার দিয়ে নদী পার হতে ১০ মিনিট লাগে। চারটি ট্রলার লাগাতার যাত্রী পারাপার করলেও প্রতিটি ট্রলারেই ভিড়। অসংখ্য মানুষ চাপাচাপি করে উঠছেন। অনেকে ট্রলারে মোটরসাইকেলও তুলছেন।
মোক্তারের চর এলাকার হৃদয় হোসেন নড়িয়া সরকারি কলেজে পড়ালেখা করে। সে বলে, কলেজের ক্লাস ও প্রাইভেট পড়া মিলে দিনে ছয়-সাতবার উপজেলা সদরে আসা-যাওয়া করতে হয়। ছয় মাস ধরে নৌকায় নদী পারাপার হচ্ছে তারা। বই-খাতা ভিজে যাওয়ার ভয় থাকে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে আরও স্রোত বেড়ে যাবে। তখন দুর্ভোগ আর ঝুঁকি আরও বাড়বে।
নড়িয়ার রাজনগর এলাকার লিয়াকত হোসেন একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। প্রতিদিন তিনি পাঁচ-ছয়বার উপজেলা সদরে যাতায়াত করেন। লিয়াকত বলেন, ‘পুরোনো সেতুটি দিয়ে আমার মোটরসাইকেল নিয়ে যাতায়াত করতাম। নতুন সেতু নির্মাণ না করেই পুরোনো সেতুটি ভেঙে ফেলায় আমরা দুর্ভোগে পড়েছি। প্রতিদিন নৌকায় করে পারাপার হতে আমাদের ভয় লাগে। নিরুপায় হয়েই তা করতে হচ্ছে।’
এ পথ দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিরা বলেন, নড়িয়া উপজেলা সদর থেকে জাজিরা হয়ে ঢাকা যাওয়ার প্রধান সড়কপথ এটি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ পথে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। কিন্তু কীর্তিনাশা নদী দিয়ে কোনো যানবাহন পারাপার হতে পারছে না। নড়িয়ার বিভিন্ন এলাকার মানুষকে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে ঢাকায় যাতায়াত করতে হলে জেলা শহরের প্রেমতলা হয়ে অন্তত ১৫ কিলোমিটার পথ ঘুরে চলতে হচ্ছে।
নতুন সেতু নির্মাণ করার কারণে পুরোনো সেতুটি গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ভেঙে ফেলতে হয়েছে। পুরোনো সেতু দিয়ে হেঁটে বা মোটরসাইকেল নিয়ে মানুষ যাতায়াত করত। এখন ওই পথে চলাচলকারী যাত্রীদের পারাপার করার জন্য এলজিইডি দুটি ট্রলার দিয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে আরও দুটি ট্রলার দিয়ে যাত্রী ও মোটরসাইকেল পারাপার করা হচ্ছে। নড়িয়া উপজেলা সদরে কলেজ, দুটি উচ্চবিদ্যালয়, চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নদী পারাপার হচ্ছে প্রতিদিন।
শরীয়তপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নড়িয়া উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে কীর্তিনাশা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পূর্ব তীরে উপজেলা সদর এবং পশ্চিম তীরে মোক্তারের চর, রাজনগর, নশাসন ও জপসা ইউনিয়ন। এ ছাড়া জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নও রয়েছে। নড়িয়া উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়কপথে ওই ইউনিয়নগুলো এবং জাজিরার যোগাযোগের জন্য ১৯৯৭ সালে কীর্তিনাশা নদীর ওপরে ১০৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি। ২০১০ সাল থেকে কয়েক বছর সেতুটির আশপাশ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও নদীভাঙনের কারণে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে সেতুটি ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করে এলজিইডি। ওই সময় থেকে সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।
২০১৭ সালে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪৫ মিটার সেতু নির্মাণ করার জন্য নাভানা কনস্ট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলেও কয়েক মাস পর তা বন্ধ করে দেয়। ২০১৯ সালে সেতুটির নির্মাণকাজ ফেলে প্রতিষ্ঠানটি চলে যায়। তখন ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। এরপর ২০২১ সালে পুনরায় দরপত্র দেওয়া হয়। এ দফায় সেতুটির সঙ্গে ভায়াডাক্ট যুক্ত করে এর দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়। ২৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০৫ মিটার সেতু ও ২২২ মিটার ভায়াডাক্টের নির্মাণকাজ পায় কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর তারিখে কার্যাদেশ পায়। ৯ জুন প্রতিষ্ঠানটির কাজের মেয়াদ শেষ হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছে।
কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের পক্ষে সেতুটির নির্মাণকাজ করছেন আবদুল ওয়াহাব মাদবর নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, নদীতে পাইলিং করতে সময় বেশি লেগেছে। ৯ জুন কাজের মেয়াদ শেষ হবে। তাঁরা কাজের মেয়াদ বাড়ানোর চিঠি দেবেন। এখন যে গতিতে কাজ চলছে, এ গতিতে চললে আরও এক বছর লাগবে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী রাফেউল ইসলাম বলেন, ২০১৭ সালে যে ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছিল, তিনি কাজটি শেষ না করে চলে যান। এলজিইডি তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন যে ঠিকাদার কাজ করছেন, তাঁরাও ধীরগতিতে করছে। তাঁদের তৎপর হওয়ার জন্য তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে। আর বিকল্প একটি ফুট ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।