সাবেক এমপিসহ বিএনপির দুই নেতাকে ১১ বছর আগে গুমের অভিযোগ অপরাধ ট্রাইব্যুনালে

লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম ও লাকসাম পৌরসভা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. হুমায়ুন কবিরছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লার লাকসামে বিএনপির দুই নেতাকে অপহরণের পর গুমের অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। আজ বুধবার দুপুরে লাকসাম পৌরসভার ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা ও গুম হওয়া বিএনপি নেতা মো. হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই গোলাম ফারুক বাদী হয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগটি দাখিল করেন। প্রায় ১১ বছর ৩ মাস আগে গুমের শিকার ওই দুই নেতার এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

গুমের শিকার দুই নেতা হলেন লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মো. সাইফুল ইসলাম (হিরু) এবং লাকসাম পৌরসভা বিএনপির সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির (পারভেজ)।

ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও কুমিল্লা-৯ আসনের (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) মো. তাজুল ইসলামের পাশাপাশি অপর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন র‌্যাব-১১–এর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র‌্যাব-১১–এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি-২–এর মেজর শাহেদ হাসান রাজীব, উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায় এবং লাকসাম থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের।

অভিযোগ দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করে বাদীপক্ষের আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগটি করা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর আশ্বস্ত করেছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

মুহাম্মদ বদিউল আলম বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সঠিকভাবে তদন্ত হলেই সব বেরিয়ে আসবে। কারণ, ওই দুই বিএনপি নেতাকে গুমের পর প্রথমে থানায় জিডি এবং পরে আদালতে মামলা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একবারও কোনো তদন্ত সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি। সবাই ঘটনাটি প্রভাবশালীর চাপে ধামাচাপা দিয়েছে। সাঈদ মোহাম্মদসহ অন্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে।’

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া অভিযোগ এবং গুম হওয়া দুই নেতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির টানা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে লাকসামে বিশেষ অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশসহ যৌথ বাহিনী। একপর্যায়ে র‌্যাবের সদস্যরা উপজেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ প্রায় এক ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেন। খবর পেয়ে ওই রাতেই সাইফুল ইসলাম, পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির এবং একই কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাকসাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। তাঁদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছালে একদল লোক অ্যাম্বুলেন্সটির গতি রোধ করে। পরে গতিরোধকারীরা নিজেদের র‌্যাব পরিচয়ে চালক ও হেলপারকে মারধর করে বিএনপির তিন নেতাকে আটক করে অন্য একটি গাড়িতে তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ওই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে জসিম উদ্দিন (অ্যাম্বুলেন্সে থাকা) এবং লাকসামে গ্রেপ্তার হওয়া ৯ জনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করেন র‌্যাব-১১–এর কুমিল্লা শাখার তৎকালীন ডিএডি শাহজাহান আলী। পরের দিন সকালে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। তবে সেই থেকে বিএনপি নেতা সাইফুল ও হুমায়ুনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এই গুমের সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, সাইফুল ইসলাম লাকসামের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সফল ব্যবসায়িক নেতা ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম। তা ছাড়া তৎকালীন বিরোধী দলের আহ্বান করা সব কর্মসূচি স্থানীয়ভাবে পালিত হতো সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে। এতে মারাত্মক ক্ষিপ্ত হন তাজুল ইসলাম। সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবির রাজনীতির মাঠে থাকলে তাজুল ইসলামের রাজনৈতিক বৈতরণি পার হওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। সে জন্য তাজুল ইসলাম পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

অভিযোগের বিষয়ে বাদী গোলাম ফারুক বলেন, ‘২০১৪ সালে এ ঘটনায় আদালতে মামলা করা হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ ও সিআইডির যারাই মামলার তদন্ত করেছে, তাদের কেউই ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কারণ, কেউই চায়নি মামলাটি আলোর মুখ দেখুক। এ জন্য সময়ক্ষেপণ করেছে তারা। এ ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় আমরা আশাবাদী, দেশজুড়ে আলোচিত এই অপহরণ ও গুমের সব রহস্য বেরিয়ে আসবে। আমরা দুই নেতার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, সেটা জানতে চাই। জড়িত ব্যক্তিদের বিচার চাই।’