বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শেষ গাছটি কোথায়

কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ছেঁড়াদিয়ার কাঠবাদাম গাছ। সম্প্রতি দ্বীপটিতে গিয়ে গাছটি আর দেখা যায়নিফাইল ছবি

বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন আরেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছেঁড়াদিয়া। এটি বাংলাদেশের সর্বশেষ ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডের মধ্যভাগে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ৬০-৭০ ফুট উঁচু বিশাল একটি কাঠবাদামগাছ। দ্বীপের প্রবীণ ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের ধারণা, গাছটির বয়স ৬০-৭০ বছরের কম নয়। সমুদ্রে চলাচলকারী মাছ ধরার ট্রলার কিংবা টেকনাফ স্থলবন্দরে যাতায়াতকারী পণ্যবাহী জাহাজ গাছটি দেখে দিক নির্ণয় করত। এখন গাছটি নেই। রাতের আঁধারে গাছটি কেটে নিয়ে গেছে কেউ।

সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গেলে কাঠবাদামগাছটি দেখা যায়নি। দ্বীপের দক্ষিণাংশের দিয়ার মাথা সৈকত থেকে দক্ষিণ দিকে গোলদিয়া দ্বীপ, তারপর কিছুটা দূরে মাঝের দিয়া, তারপর ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ। ছেঁড়াদিয়ার পর বাংলাদেশের আর কোনো ভূখণ্ড নেই। তাই এটি ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শেষ বড় গাছ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এম এ গফুর গবেষণা কাজে বেশ কয়েকবার সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদিয়ায় গেছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এ ধরনের গাছ বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গাছের শেকড় ও মাটি, মাঝের কাণ্ড ও ঊর্ধ্বাংশে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে নানা ক্ষুদ্র ও বড় জীব বসবাস করে। তাই দেশের সর্বশেষ ভূখণ্ডের গাছটির পরিবেশগত গুরুত্ব ছিল।

গত বছরের জানুয়ারিতেও ওই তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে প্রচুর কেয়াগাছ দেখা গেছে। এখন তার কিছুই নেই। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দিয়ার মাথা সৈকতে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকে তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের হতশ্রী চেহারা দেখে ক্ষুব্ধ পরিবেশকর্মীরা। কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরও দিয়ার মাথায় দাঁড়িয়ে ছেঁড়াদিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ৬০-৭০ বছর বয়সী কাঠবাদামগাছটি দেখা গিয়েছিল। এত বড় ও বয়স্ক বাদামগাছ কক্সবাজারের কোথাও চোখে পড়েনি। গাছটিকে ঘিরে বাদুড় ও পাখির অভয়ারণ্য গড়ে ওঠে। বাদাম খেয়ে বাঁচত প্রাণীকুল। স্থানীয় অনেকে গাছের বাদাম ও বীজ সংগ্রহ করতেন। এ ছাড়া এটি দেশের সর্বশেষ ভূখণ্ডের একমাত্র বড় গাছ হওয়ায় ল্যান্ডমার্ক হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন মহিরুহ কে কেটে নিল, তদন্ত দরকার।

এ প্রসঙ্গে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে দ্বীপে বেশ কয়েকটি ঝোড়ো হাওয়া আঘাত হেনেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সে সময় তীব্র বাতাসে বাদামগাছটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন স্থানীয় কেউ গাছটি কেটে কিংবা চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েও গাছটির খোঁজ মেলেনি। ছেঁড়াদিয়ায় পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজনের যাতায়াত নিষিদ্ধ হলেও অনেকে রাতের বেলায় সেখানে মাছ ধরতে যাচ্ছেন।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এই প্রতিবেদক ছেঁড়াদিয়ায় গিয়ে কাঠবাদামগাছটি দেখেন। ওই প্রতিবেদকের সঙ্গে ছিলেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী ও জেলা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। তাঁরা ছেঁড়াদিয়া দ্বীপের প্রবাল শৈবাল, প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটকের উপস্থিতি দেখতে গিয়েছিলেন। ওই সময় তাঁরা কাঠবাদামগাছটির কাছে যান। অন্তত ৬০-৭০ ফুট উচ্চতা এবং আড়াই ফুট বেড়ের বিশাল কাঠবাদামগাছটির গোড়ায় তখন কয়েকটি বড় আকারের গর্ত (ছিদ্র) দেখা গিয়েছিল। সেখানে বেশ কিছু বাদুড় বাসা বেঁধেছিল। গাছে ছিল পাখির বাসা। বাদামে ভরপুর গাছটি দেখতে যাওয়া কয়েকজন পর্যটকের দেখাও মিলেছিল তখন।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে দিয়ারমাথা সৈকতে দাঁড়ালে দুটো দ্বীপ গোলদিয়া ও ছেঁড়াদিয়া দেখা যায়। ডান পাশের ছেঁড়াদিয়া দেশের শেষ ভূখণ্ড। এক সময় এই স্থান থেকে কাঠবাদাম গাছটি দেখা যেত। বর্তমানে সেটি আর নেই।সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ছেঁড়াদিয়ায় পর্যটকের যাতায়াত আগে থেকেই নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শত শত মানুষ ইঞ্জিন নৌকা ও দ্রুতগতির কয়েকটি স্পিডবোট নিয়ে ছেঁড়াদিয়ায় যাতায়াত করেন। এখনো সন্ধ্যায়, রাতে অনেকে ছেঁড়াদিয়ায় যাচ্ছেন অবৈধভাবে।

আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে ছেঁড়াদিয়ার চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাথরের স্তূপ থেকে প্রবাল এবং বালুচর থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করতেন কিছু মানুষ। গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত সীমিত করে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১ ডিসেম্বর থেকে জাহাজে চড়ে দৈনিক দুই হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন। টেকনাফের বিকল্প হিসেবে কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ-জেটি ঘাট থেকে দৈনিক পাঁচটি জাহাজ সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত করছে। ৩১ জানুয়ারি জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আর কারও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ থাকবে না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ছেঁড়াদিয়ার দুর্লভ কাঠবাদামগাছটি উধাও হওয়ার ঘটনা রহস্যজনক। প্রায় পাঁচ হাজার নারকেলগাছে ভরপুর সেন্ট মার্টিন ছাড়াও টেকনাফ-কক্সবাজারের কোথাও এত বয়স্ক কাঠবাদামগাছ দেখা যায় না।

দ্বীপের মাঝের পাড়ার জেলে মোহাম্মদ রহিম (৬০) বলেন, গত বছরের জুলাই মাসেও তিনি ছেঁড়াদিয়ায় মাছ ধরতে গিয়ে কাঠবাদামগাছটি দেখেছেন। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হলেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বাদামগাছটি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণপাড়ার সৈকত থেকে খালি চোখে দেখা যেত। বঙ্গোপসাগরের কয়েক কিলোমিটার দূরে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারের জেলেরা বাদামগাছটি দেখে দ্বীপের অবস্থান শনাক্ত করে সাগরে চলাচল করতেন। এখন গাছটি কোথায় গেল, কে বা কারা কেটে নিল, জানা যাচ্ছে না।

সেন্ট মার্টিনের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, পাঁচ একর আয়তনবিশিষ্ট ছেঁড়াদিয়ায় ফলদ গাছ বলতে এই কাঠবাদামগাছটি ছিল। গাছটির বয়স ৫০ বছরের বেশি হতে পারে। সাগরের জোয়ারে কোনো দেশ থেকে বাদামের বীজ ভেসে ছেঁড়াদিয়ায় উঠতে পারে। তা থেকে গাছটির সৃষ্টি বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ছেঁড়াদিয়ায় কোনো লোকবসতি নেই। গাছটিও কেউ রোপণ করেননি।