গোমতীর বাঁধ মেরামতে কেটে নেওয়া হচ্ছে কৃষিজমির মাটি, কৃষকদের অসন্তোষ
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কিং বাজেহুরা গ্রাম। গ্রামের বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে গোমতী নদীর চর। গ্রামের পাশেই বুড়বুড়িয়া গ্রামে ২২ আগস্ট রাতে গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল বুড়িচংসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলা। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে ওই বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে, এখনো শেষ হয়নি।
মঙ্গলবার সরেজমিনে কিং বাজেহুরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চরের কৃষিজমিতে মাটি কাটা হয়েছে গভীরভাবে। কোথাও একসঙ্গে কয়েকটি জমি, আবার কোথাও কয়েকটি জমি পরপর গভীর গর্ত করে মাটি কাটা হয়েছে। পুকুর আকৃতির এমন গর্তের সংখ্যা অন্তত ৩০। চর থেকে খননযন্ত্র দিয়ে কৃষিজমির মাটি কাটার পর হালচাষের ট্রাক্টরের পেছনে লাগানো ট্রলিতে করে মাটি নেওয়া হচ্ছে। কিং বাজেহুরা, নানুয়ার বাজারের পাশসহ বিভিন্ন এলাকায় বিস্তীর্ণ চরজুড়েই এখন কৃষিজমিতে এমন গভীর গর্ত।
স্থানীয় মানুষদের ভাষ্য, প্রতিদিনই চরের কৃষিজমির মাটি এভাবে খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে কেটে নেওয়া হচ্ছে। এসব মাটি যাচ্ছে বুড়বুড়িয়া এলাকায় ভেঙে যাওয়া গোমতীর বেড়িবাঁধ সড়ক নির্মাণের কাজে। এরই মধ্যে যেসব জমির মাটি কেটে পুকুর বানানো হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ জমিতেই কোনো না কোনো ফসল ছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কখনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধিগ্রহণকৃত জমির কথা বলে, আবার কখনো কৃষকদের টাকার লোভ দেখিয়ে এভাবে মাটি কেটে নিয়েছেন।
বেড়াজাল গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জয় সাহা বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আমাদের তিনটি জমিতে পুকুর আকৃতির বড় বড় গর্ত করে মাটি নেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি। কিন্তু তারা চাইলে দূরের অনাবাদি জমিগুলো থেকেও মাটি এনে ওই বাঁধ মেরামত করতে পারত।’
সঞ্জয় সাহা বলেন, ‘মাটি কেটে নেওয়ার সময় তারা বলেছে, এসব সম্পত্তি নাকি পাউবোর বা সরকারি খাসজমি। কিন্তু আমাদের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে এখানে কৃষি আবাদ করছে, আমাদের কাগজপত্র আছে। আমরা এ নিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় অন্তত তিনজন কৃষক বলেন, ঠিকাদারের লোকজন কয়েকজন কৃষককে টাকা দিয়ে এভাবে মাটি কেটে নিয়েছেন। আবার অনেক কৃষকের জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত জায়গা বলে কেটে নিয়ে গেছেন। সরকারি কাজ, এ জন্য কেউ ভয়ে কথা বলছেন না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাউবো কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘প্রায় ১১০ মিটার ভেঙে যাওয়া বাঁধটি ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স চৌধুরী ট্রেডার্স। বাঁধের জন্য মাটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের। তারা কীভাবে মাটি ম্যানেজ করছে, আমরা জানি না। যদি তারা জমির মাটি নিয়ে থাকে, হয়তো কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করেই নিয়েছে। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে পলি জমে এসব জমি আবার ভরাট হয়ে যাবে। এরপরও বিষয়টি আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।’
স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, যেভাবে জমিগুলোতে গর্ত করে মাটি তোলা হয়েছে, এসব জমিতে আর কখনোই ফসল আবাদ করা সম্ভব হবে না; বরং পুকুর আকৃতির গভীর গর্ত হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে আশপাশের কৃষিজমি ভেঙে পড়তে পারে।
অভিযোগের বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স চৌধুরী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী কৃষাণ দত্ত চৌধুরী বলেন, ‘বাঁধটি মেরামতের জন্য অনেক মাটি দরকার। আমরা পাউবোর কিছু অধিগ্রহণ করা জমি থেকে মাটি এনেছি। আর কৃষিজমিগুলোর মাটি আমরা মালিকদের থেকে কিনে নিয়েছি। যেসব জমিতে ফসল ছিল, আমরা কৃষকদের সেই ক্ষতিপূরণও দিয়েছি। একজন জমির মালিকও বলতে পারবেন না টাকা দেওয়া ছাড়া বা জোর করে আমরা তাঁদের জমির মাটি কেটেছি। যদি কেউ বলেন আমরা অনুমতি বা টাকা ছাড়া মাটি কেটেছি, তাহলে মিথ্যা কথা বলছেন। বাঁধ নির্মাণের স্বার্থেই আমরা এভাবে মাটি আনতে বাধ্য হয়েছি।’
এদিকে প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে কাজ শুরু হলেও বুড়বুড়িয়া এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধটির মেরামতকাজ এখনো শেষ হয়নি। বাঁধ ভাঙা থাকার কারণে প্রায় সাড়ে ৪ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পালপাড়া থেকে বুড়িচংয়ের কংশনগর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়কটি। যার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সড়কটি দিয়ে চলাচলকারীরা।
এ প্রসঙ্গে পাউবো কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘বাঁধের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করছি দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজটি সমাপ্ত হবে। আমরা চাইলে আরও এক মাস আগেই কাজ শেষ করতে পারতাম। কিন্তু বাঁধটি নির্মাণ করা হচ্ছে মাটি দিয়ে, তাই মাটি যেন বসতে পারে, এ জন্য সময় দিতে হচ্ছে।’