‘আমার আর কিছু থাকল না, বাঁচব ক্যামনে’

ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ইমনের বাবা ঝন্টু খালাসীর আহাজারি। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। রোববার বিকেলে ভাঙ্গার চুমুরদী ইউনিয়নের রায়পাড়া সদরদী গ্রামেছবি: প্রথম আলো

অভাবের সংসারে বাবার আয়ে সংসার চলত না। বাধ্য হয়ে অষ্টম শ্রেণিতে থেকে কাজের সন্ধানে নেমে পড়েন। ভাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করতেন। তাঁর আয়েই চলত পরিবারের যাবতীয় খরচ, তিন বোনের পড়াশোনা।

উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন মা মাহফুজা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার কী সর্বনাশ হয়ে গেল রে। ওরে বাবা, বাবা রে। আমার আর কিছু থাকল না। এখন আমরা বাঁচব ক্যামনে?’

গতকাল শনিবার বিকেলে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের সলিলদিয়া এলাকায় ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় ইমন খালাসীসহ (২২) তাঁর আরেক বন্ধু নিহত হন। তাঁর নাম রমজান ওরফে তৌকির (২০)। তাঁদের বাড়ি ভাঙ্গার চুমুরদী ইউনিয়নের রায়পাড়া সদরদী গ্রামে। মোটরসাইকেলে দুই বন্ধু মাদারীপুরের শিবচরে যাওয়ার পথে ডাম্প ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁরা নিহত হন।

ওই মোটরসাইকেলের আরেক আরোহী ছিলেন একই গ্রামের আবুল কাশেম (২১)। তিনি মোটরসাইকেলে সবার পেছনে বসা ছিলেন। মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন ইমন। দুর্ঘটনায় কাশেম আহত হন। তিনি ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। ইমনের মৃত্যু হয় বিকেলে। আর রমজান মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শনিবার রাতে একজনকে এবং আজ রোববার সকালে আরেকজনকে স্থানীয় মিনার মসজিদ-সংলগ্ন গোরস্থানে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়।

আজ বিকেলে রায়পাড়া সদরদী গ্রামে ইমনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বেদনাবিধুর পরিবেশ। হতদরিদ্র ইমনদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। বাড়িতে বারান্দাযুক্ত একটি চৌচালা টিনের ঘর। ভিত পাকা হলেও শুধু ইটের গাঁথুনি, প্লাস্টার করা হয়নি। পাশে পাটখড়ির বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি রান্নাঘর। ইমনের বাবা ঝন্টু খালাসী আগে ইজিবাইক চালাতেন। এখন দিনমজুরি করেন। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ইমন সবার বড়। তিন বোনের মধ্যে একজন অষ্টম, একজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং আরেকজন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

বাড়ির উঠানে বসে আহাজারি করছিলেন ইমনের বাবা ঝন্টু খালাসী। ঝন্টুর বড় ভাই হুমায়ুন খালাসী ও শ্যালক মোহাম্মদ আলী তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আহাজারি করতে করতে ঝন্টু খালাসী বলেন, ‘এখন সংসার কীভাবে চলবে। সংসারের সব খরচ তো ইমনই চালাত। ওর বোনদের পড়াশোনার কী হবে?’

ইমনদের চেয়ে রমজানের পরিবার কিছুটা সচ্ছল। রমজানের বাবা কামরুল খান ভাঙ্গা বাজারে দরজির দোকানে কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করেন। রমজান ভাঙ্গা সরকারি কাজী মাহবুব উল্লাহ কলেজ থেকে ২০২৩ সালে মানবিক শ্রেণি থেকে এইচএসসি পাস করেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

রমজানের বাবা কামরুল খান বলেন, রমজান ও ইমন ছিলেন মানিকজোড়। সব সময় তাঁরাসহ ৮ থেকে ১০ জনের একটি দল এলাকার পরিবেশ ভালো রাখাসহ নানা কাজ করত।

ভাঙ্গার চুমুরদী ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও রায়পাড়া সদরদী গ্রামের জালাল ভূঁইয়া বলেন, এলাকার একটি ওয়াজ মাহফিলকে সামনে রেখে এক বক্তাকে দাওয়াত দিতে দুই বন্ধু মাদারীপুরের শিবচর যাচ্ছিলেন। পথে দুর্ঘটনার শিকার হন। রমজান গরিবদের কাছে ইফতার পৌঁছে দেওয়া, নামাজের জন্য মসজিদে ডেকে নেওয়া, মাদক থেকে দূরে থাকাসহ বিভিন্ন কাজ করতেন। একসঙ্গে দুই বন্ধুর এ মৃত্যুতে এলাকাবাসী শোকাহত।