খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ও দোকানপাট এখনো মেরামত চলছে। এ ঘটনায় গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে এক ডজন সুপারিশ দিয়েছে।
সহিংসতার ঘটনায় হওয়া মামলাগুলোর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। পাহাড়ি–বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনায় খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় রাঙামাটিতে চারজন এবং খাগড়াছড়িতে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তদন্তে আর কোনো গতি নেই। বরং মামলাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক হয়রানি হিসেবে।
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি–বাঙালি সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এরপর তা রাঙামাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে নিহত হন চারজন। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে দুই শতাধিক দোকানপাট ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আঞ্চলিক পরিষদেও আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর দুই পার্বত্য জেলা পরিদর্শন করেন তিন উপদেষ্টা। দোষীদের শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেন তাঁরা।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরীকে প্রধান করে একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি ২৩ অক্টোবর তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
জানতে চাইলে কমিটির সদস্য খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাসান মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এতে ঘটনার কারণ উল্লেখ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বেশ কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রায় ১৪টি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে পাহাড়ি–বাঙালিদের সমন্বয়ে একটি কমিটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ রয়েছে।
জানতে চাইলে কমিটির প্রধান মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে ঘটনা এড়াতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো, দোষীদের শাস্তি, পুলিশের আরও তৎপরও সজাগ থাকার বিষয়গুলো রয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ি বাঙালিদের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে সম্প্রীতি সভাসহ নানা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
সুপারিশের মধ্যে প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে পাহাড়ি বাঙালিদের সমন্বয়ে একটি কমিটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ রয়েছে।
ক্ষতিপূরণ পর্যাপ্ত নয়
রাঙামাটির বনরূপা এলাকা থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ঘটনার সূত্রপাত হয়। এখানে শতাধিক বাড়ি, অফিস–আদালত ও দোকানপাটে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। বনরূপা বাজারের পাশে বিজয় চাকমার বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে সেমিপাকা ঘরটি পুড়ে যায়। আসবাবসহ সবকিছু পুড়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, এখনো পোড়া শূন্য ভিটে পড়ে আছে। সেখানে ছাই এবং কিছু পোড়া টিন রয়েছে। বাড়ির মালিক বিজয় চাকমাকে পাওয়া যায়নি। পরে বিজয় চাকমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি এখন এক আত্মীয়ের বাসায় পরিবার নিয়ে আছি। সেদিন যখন ঘটনা আঁচ করতে পারি, তখন পাশে একটি ভবনে প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিই। সেখান থেকে নিজের ঘর পুড়ে যাওয়ার চিত্র দেখতে পাই। কবে এই বাড়ি তৈরি করতে পারব জানি না।’ তাঁকে এ পর্যন্ত ৪৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর অন্তত ৪০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বিজয় জানান।
সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পেনশনের টাকায় কালিন্দিপুরে আগস্ট মাসে একটি মুদিদোকান খুলেছিলেন সনজিত চাকমা। সংঘর্ষের দিন তাঁর দোকান লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সনজিত বলেন, তাঁর সাড়ে ১৬ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে। কিছু পুড়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা।
বনরূপা বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. শাহজাহানও পেয়েছেন ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ। শাহজাহান বলেন, ‘সেদিন আমার দোকানের সব সবজি রাস্তায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে।’
রাঙামাটির আঞ্চলিক পরিষদে আগুনে পুড়ে যাওয়া ৯টি গাড়ি এখনো নিচতলায় সেদিনের ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। এই কার্যালয়ের ক্ষয়ক্ষতি ১০ কোটি টাকার বেশি।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে ১৯ সেপ্টেম্বর আগুন দেওয়া হয়। আগুনে শতাধিক ভাসমান দোকান পুড়ে যায়। এর বাইরে ৮৬টি স্থায়ী দোকান পুড়ে যায়। এ ছাড়া খাগড়াছড়িতে ১৯টি দোকান ভাঙচুর হয়। এখানকার দোকানদারেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা নগণ্য। লারমা স্কয়ারের পুড়ে যাওয়া অর্ধেক দোকান এখনো চালু হয়নি।
লারমা স্কয়ারের দোকানদার সমর বিকাশ চাকমা ঘটনার পর থেকে ঘরে বসে আছেন। তাঁর একটা চায়ের দোকান ছিল। ওই দোকানে প্রথম সেদিন আগুন দেওয়া হয়েছিল। এখনো পোড়া ভিটে পড়ে আছে। সমর বিকাশ বলেন, ‘আগের অনেক ধারদেনা আছে। এখন নতুন করে ধারদেনা করে দোকান পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছি। কবে নির্মাণ করতে পারব, জানি না। এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে।’ একই বাজারের আকতার হোসেনের সার ও গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানটিও এখনো চালু করতে পারেননি। অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ব্যবসায়।
মামলার অবস্থা
সংঘর্ষ এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ আসামি অজ্ঞাতপরিচয়ের। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থানায় একটি মামলা হয়। এই মামলায়ও অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। কিন্তু দুই মাসেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার করা যায়নি। দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, ওই মামলা তদন্তাধীন আছে। এখনো কোনো গ্রেপ্তার নেই।
এ ছাড়া মামুনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী মুক্তা আকাতর হত্যা মামলা করেন। তাতে আসামি তিন আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁরা হলেন রফিকুল আলম, দিদারুল আলম ও মো. শাকিল। বাকিরা অজ্ঞাতপরিচয় আসামি। এর মধ্যে সদর উপজেলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান দিদারুল আলমকে এক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ২০ সেপ্টেম্বর রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় সদর থানায় পৃথক আরেকটি মামলা হয় সদর থানায়।
খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল বাতেন মৃধা বলেন, এসব মামলায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার ওসি শাহেদ উদ্দিন বলেন, রাঙামাটিতে সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। তাতে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আর কোনো গ্রেপ্তার নেই।
যা ঘটেছিল
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরে মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে পিটুনিতে মামুন নামের এক ব্যক্তি মারা যান। পরদিন বিকেলে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দীঘিনালা উপজেলা সদরে মামুন হত্যার প্রতিবাদে বাঙালিরা মিছিল বের করেন। তখন পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। নিহত হন ধনঞ্জয় চাকমা নামের এক ব্যক্তি। আগুন দেওয়া হয় লারমা স্কয়ারে দোকানপাটে।
একই দিন রাতে শহরের স্বনির্ভর এলাকায় গুলিতে রুবেল ত্রিপুরা ও জুনান চাকমা নামের দুই তরুণ মারা যান। ২০ সেপ্টেম্বর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পাশের জেলা রাঙামাটিতে। সেখানেও অনিক চাকমা নামের এক কলেজছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দোকানপাট এবং বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এরপর ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুলের শিক্ষক সোহেল রানাকে ধর্ষণের অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পুনরায় খাগড়াছড়িতে হামলা ও ভাঙচুর হয়। এই ঘটনায় আরও দুটি পৃথক মামলা হয়। এতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।