চুয়েটের হলে গভীর রাতে শিক্ষকের মদ পান নিয়ে স্ত্রীর চেঁচামেচির অভিযোগ, তদন্ত কমিটি গঠন
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একটি হলে গভীর রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক শিক্ষকের মদ পান ও এ নিয়ে তাঁর স্ত্রীর চেঁচামেচির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশের মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তারেক হুদা হলে গত শুক্রবার দিবাগত রাত ৪টায় ওই ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে হলটির প্রাধ্যক্ষ নিপু কুমার দাসের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ওই কমিটি গঠন করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন শিক্ষার্থী সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার চুয়েটের ৪৯ তম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী উৎসব উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠে কনসার্টের আয়োজন করা হয়। কনসার্টের একপর্যায়ে রাত চারটায় শহীদ তারেক হুদা হলে কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে মদ পানরত অবস্থায় ছিলেন পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক শাফকাত আর রুম্মান। এর কিছুক্ষণ পর তাঁর স্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক কাজী জান্নাতুল ফেরদৌস ঘটনা স্থলে পৌঁছান। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের সামনে মদ পানরত অবস্থায় স্বামীকে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ও উপস্থিত সবাইকে বকাঝকা করেন। একপর্যায়ে তিনি হলের নিচে নেমে রাস্তায় আহাজারি করতে থাকেন। পরে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা জান্নাতুলকে শান্ত করেন ও ওই শিক্ষককে ধরাধরি করে শিক্ষক ডরমিটরিতে পৌঁছে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সময় হলটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তৃতীয় তলায় চেঁচামেচি শুনতে পান। তিনি অন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানতে পারেন ওই শিক্ষক দম্পতি গন্ডগোল করছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর তাঁরা (শিক্ষক দম্পতি) হল থেকে বের হয়ে যান। এ সময় শাফকাত তাঁর স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন ও চেঁচামেচি না করার অনুরোধ করেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এমন আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রথমে হলের তিনতলায় চেঁচামেচি শুনি। দেখি এক মেয়ে একজনকে বকাঝকা করছেন ও থাপ্পড় দিচ্ছেন। এরপর নিচে এসে ওনার বাড়িতে মোবাইলে ঘটনা (মদ পানের) জানাচ্ছিলেন।’
তবে এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন ওই শিক্ষক দম্পতি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে শাফকাত আর রুম্মান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এটি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আমি শিক্ষা সমাপনী উৎসবে উপদেষ্টা হিসেবে ছিলাম। রাত সাড়ে ৩টা নাগাদ ক্যাম্পাসের বঙ্গবন্ধু মোড়ালের সামনে ৪-৫ জন বহিরাগতকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে আমি তাদের ডাক দিই। সঙ্গে সঙ্গে ওরা দৌড় দিয়ে শহীদ তারেক হুদা হলে প্রবেশ করে। আমি হলে প্রবেশ করে তাদের ধরতে না পেরে শিক্ষা সমাপনী উৎসব আয়োজক কমিটিকে ডেকে নিয়ে এসে তাদের এ বিষয় জানিয়ে সতর্ক করি। কোনো কারণে আমার স্ত্রী আমাকে তখন ফোনে পান নাই বলে সেখানে কিছু একটা হয়। সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। এ রকম মিথ্যা অভিযোগ শুনে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি ও বিব্রতবোধ করছি।’
প্রভাষক কাজী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘রুম্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক দলের সদস্য। তিনি উৎসবের সব বিষয় তদারকি করছিলেন। হয়তো তিনি হলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি ছাত্রহলে যাইনি। আমি রাত ১২টায়ই কনসার্ট থেকে (বাসায়) চলে এসেছিলাম।’
তবে ছাত্রহলটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ওই শিক্ষক দম্পতির ঘটনার সত্যতা দাবি করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, সেদিন ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই হল প্রাধ্যক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে শহীদ তারেক হুদা হলের প্রাধ্যক্ষ নিপু কুমার দাস বলেন, ‘মদ পানরত অবস্থায় আমরা তাঁকে (শাফকাত) দেখতে পাইনি। তবে অভিযুক্ত দুই শিক্ষক হলে প্রবেশ করেছিলেন এবং সে সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ছিল এটি সত্য। আমরা হলের সিসিটিভি ফুটেজে পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। হল থেকে ভোর ৪টা নাগাদ আমাকে ফোন দিয়ে একজন নারী হলে প্রবেশ করে শোরগোল করছেন বলে জানানো হয়। পরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে জানতে পারি ওই নারী উক্ত শিক্ষকের স্ত্রী ও আমাদের একজন শিক্ষক।’ তিনি বলেন, ‘হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি এবং এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
এ বিষয়ে পুরকৌশল ও পরিবেশ অনুষদের ডিন সুদীপ কুমার পাল বলেন, ‘ঘটনাটি শুনে অনেক খারাপ লাগছে। শিক্ষকেরা হচ্ছেন রোল মডেল। যারা ছাত্রদের শেখাবে তারা এ রকম কাজ করলে এটি খুবই উদ্বেগজনক। এগুলো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে পড়ে না। বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত কমিটির সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক সুনীল ধর বলেন, খুব দ্রুতই কমিটি কাজ শুরু করবে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। কমিটিতে তাঁর সঙ্গে সদস্য হিসেবে রয়েছেন, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, ‘তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও চাকরি বিধি অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’