৩০০ বছরের পুরোনো মোগল ফৌজদারের মসজিদ
ছয়-গম্বুজের মসজিদ। পদ্মফুলের ওপর কলসের নকশায় সাজানো হয়েছে গম্বুজের চূড়া। কমলা রঙে রঙিন গম্বুজের জৌলুশ যেন কিছুটা ম্লান করে দেয় মসজিদটির বাইরের দেয়াল। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া দেয়ালটিতে শেওলা জমেছে। যদিও মসজিদের ভেতরে সবকিছুই বেশ পরিপাটি। মসজিদটির ভেতরে-বাইরের নানা কারুকার্য আর স্থাপত্যশৈলী ছড়ায় মুগ্ধতা।
চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারে অবস্থিত এই মসজিদটি। নাম ‘ওয়ালী বেগ খান জামে মসজিদ’। তবে পরিচিত ‘অলি খাঁ মসজিদ’ নামেও। মসজিদটির বয়স তিন শ বছরের বেশি। চট্টগ্রাম নগরে আঠারো শতকের আগে নির্মিত সাতটি পাকা মসিজদের বিবরণ বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া যায়, যার এর একটি এই মসজিদ।
চট্টগ্রামের মুসলিমদের পুরাকীর্তির বিবরণসহ প্রথমবারের মতো বেশ কিছু শিলালিপির পাঠ পাওয়া যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর এক সদস্যের লেখা ভ্রমণবৃত্তান্তে। তাঁর নাম—ক্যাপ্টেন পগসন। ১৮৩১ সালে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ক্যাপ্টেন পগসন্স ন্যারেটিভ ডিউরিং এ ট্যুর টু চাটিগাঁও’ নামের বই। এতে চট্টগ্রামের চারটি শিলালিপি সংবলিত মুসলিম পুরাকীর্তি এবং তিনটি শিলালিপিবিহীন মসজিদের নাম উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে ওয়ালী বেগ খান মসজিদের নামও।
ঐতিহাসিকদের মতে, এই মসজিদটি নির্মাণ করেন মোগল ফৌজদার (আঞ্চলিক শাসনকর্তা) ওয়ালী বেগ খান। তাঁকে চকবাজারের প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়। চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষক আবদুল হক চৌধুরী তাঁর ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৭১৪ থেকে ১৭১৯ সালের মধ্যে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটানোর জন্য জেলার রাউজান থানার কদলপুর, মিরসরাইয়ের নিজামপুর এবং সন্দ্বীপে ১২০ দ্রোণ (এক দ্রোনে ৮ একর) জমি ওয়াক্ফ করেছিলেন ওয়ালী বেগ খান। মসজিদের পাশে ‘কমলদহ’ নামের একটি দিঘি থাকার উল্লেখও বইটিতে রয়েছে।
আবদুল হক ছাড়াও আরও বেশ কিছু গবেষকের ইতিহাসবিষয়ক বইয়ে একই এলাকায় মোগল ফৌজদার ওয়ালী বেগ খানের আবাসসহ-কাছারি নির্মাণ আর দিঘি খননের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এসব এখন নেই। কালের সাক্ষী হয়ে আছে কেবল মসজিদটি।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে মসজিদটি দেখা হলো। সড়ক থেকে প্রায় সাড়ে চার ফুট উঁচুতে মসজিদটির অবস্থান। মসজিদের সামনে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ। একটি প্রবেশপথ খোলা থাকলেও দুটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে দুটি করে প্রশস্ত জানালা। এর মধ্যে উত্তর পাশের একটি জানালা ব্যবহার হচ্ছে প্রবেশপথ হিসেবে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের জন্য এসব জানালা নির্মাণ করা হলেও তিন পাশে নতুন অবকাঠামোর কারণে এখন সেই সুযোগ খুবই সীমিত।
মসজিদের দেয়ালজুড়ে রয়েছে অনেক কুলঙ্গি (খোপ)। এসব কুলঙ্গির কোনোটা খালি রয়েছে, কোনোটাতে পবিত্র কোরআন ও তসবি রাখা। কিবলা দেয়ালে একটি মিহরাব রয়েছে। তবে এ দেয়াল থেকে আরও দুটি পার্শ্ব-মিহরাব পরে সংস্কারের সময় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৮ ফুট। প্রস্থ ৪২ ফুটের মতো। বর্তমানে মসজিদের ভেতরে আটটি কাতারে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় ১-৩ ফুট। পশ্চিম দিকের ছাদে মিনার সদৃশ চারটি ছোট টাওয়ার রয়েছে। এগুলো দেখে ধারণা করা যায়, অন্তত সামনের দিকটাতেও এ ধরনের টাওয়ার ছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের কিউরেটর পদে থাকা প্রয়াত গবেষক শামসুল হোসাইন ‘মুসলিম মনুমেন্ট অব চিটাগং’ নামে একটি বই লেখেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে চুন, সুরকি আর মর্টারে। শামসুল হোসেন উল্লেখ করেন, মোগল আমলের শেষের দিকে চট্টগ্রামে শুলকবহর, কাতালগঞ্জ নৌ-যাতায়াতের সুবিধার কারণে শহরের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। এই মৌজায় গড়ে তোলা মসজিদটিতে প্রথম খাদেম ছিলেন শাহ আবদুল্লাহ, যাঁকে লখনো থেকে আনা হয়েছিল। মোগল আমলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়েছে বলেও বইটিতে উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে মোগল আমলের এই মসজিদের সঙ্গে লাগানো ছয়তলা ভবনে একসঙ্গে নামাজ আদায় হচ্ছে। মসজিদ কমিটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানান, পুরোনো মসজিদটিতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১০ সালে সেটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে স্থানীয়দের অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। পরে পুরোনো মসজিদটি না ভেঙে পাশে ছয়তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
মসজিদে কমিটির অর্থ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রতি ওয়াক্তে হাজার-দেড়েক মুসল্লি এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। জুমার নামাজের সময় ৫ থেকে ৬ হাজার মুসল্লির সমাগম হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে মসজিদের নামে রাউজান, মিরসরাই ও সন্দ্বীপে কোনো জমি নেই।
২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গেজেটের মাধ্যমে মোগল আমলে নির্মিত মসজিদটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। ওয়ালী বেগ খান মসজিদ কমিটির সদস্য কামরুল হাসান প্রথম আলকে বলেন, পুরোনো মসজিদটি যখন ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মসজিদটি পরিদর্শন করেন। তখন তাঁরা জানিয়েছিলেন, মসজিদটিকে আগের রূপে ফিরিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করা হবে। এরপর গেজেটভুক্ত করা হলেও পুরোনো মসজিদটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগই নেয়নি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।