সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষতচিহ্ন
উপকূলে ঘূর্ণিঝড় রিমাল তাণ্ডব চালিয়েছে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রকৃতি। যত সময় যাচ্ছে, এই বনের ক্ষত সামনে আসছে।
বনের কটকা, কচিখালী, দুবলা ও হিরণ পয়েন্টের সৈকতে মৃত হরিণ পড়েছিল। এখন পর্যন্ত ৪০টি হরিণ উদ্ধার করে মাটিচাপা দিয়েছে বন বিভাগ। এ ছাড়া তীব্র বাতাসে উপড়ে গেছে প্রচুর গাছপালা, ভেঙেছে অসংখ্য গাছের ডালপালা। সাগরের লোনাপানি ঢুকে গেছে বন্য প্রাণীর জন্য তৈরি করা মিঠাপানির পুকুরসহ শতাধিক জলাশয়ে।
বুধবার সুন্দরবনের কিছু এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গাছের ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সুন্দরবনের বস্টুমখালী খালের মুখে ভেঙে পড়ে আছে বিরাট এক গেওয়াগাছের ডাল। বনের মধ্যে গাছগুলোর পাতা দীর্ঘ সময়ের ঝোড়ো বাতাসে স্বাভাবিকতা হারিয়ে উল্টো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পাতার ওপরের অংশ নিচে আর নিচের অংশ ওপরে উল্টে গেছে। ঝরে পড়েছে গাছের ফুল। শোনা যাচ্ছে না আগের মতো পাখির কিচিরমিচির শব্দ। বনের মধ্যে বন বিভাগের ছোট স্থাপনাগুলো ভেঙে গেছে। এ যেন বিবর্ণ রূপ নিয়েছে চিরচেনা সুন্দরবন।
সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার বললেন, বাতাসের চেয়ে ডুবে থাকা বনভূমি প্রাণীর জন্য বেশি ক্ষতিকর হয়েছে। ঝড়ের পুরো সময় বনভূমিও প্লাবিত ছিল। এর আগের ঝড়গুলোতে সর্বোচ্চ ১০-১২ ঘণ্টা বাতাস ও পানি ছিল। এবার ভাটার সময়ও বন থেকে পানি নামেনি। জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন ডুবে ছিল প্রায় ৩০ ঘণ্টা। ঝড়ের পর আর আগের মতো পাখির দেখা মিলছে না।
এই বন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে প্রাণী বা বনের ক্ষতির সঠিক হিসাব বের করা কঠিন। কারণ, সাড়ে ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বনের অনেক অংশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। গত সোমবার সন্ধ্যায় জোয়ারের সময় একটি হরিণশাবক ভেসে এসেছিল পার্শ্ববর্তী কয়রার লোকালয়ে। আমরা উদ্ধার করে বনের উঁচু জায়গায় ছেড়ে দিয়েছি। ঝড়ের দুই দিনে কয়রা এলাকা থেকে চারটি ভেসে আসা হরিণ উদ্ধার করে বনে ছাড়া হয়েছে।’
সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ৪০টি হরিণ ও একটি বন্যশূকর মারা গেছে। ভেসে যাওয়া ২০টি হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনের ১১ কিলোমিটার গোলপাতা বাগান। পাড় ভেঙে লোনাপানি ঢুকেছে বনের ৫০টি পুকুরে। বন্য প্রাণী এসব পুকুরের মিঠাপানি পান করত। এ ছাড়া বনের মধ্যে ৯টি রাস্তার ২৬৩০ ফুট, ২৫টি জেটি, একটি পন্টুনের বেজ, আটটি সোলার প্লেট, তিনটি ব্যারাক, একটি মধু জাদুঘর, দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার, তিনটি সাইনবোর্ড, তিনটি গোলঘর ও একটি জেনারেটর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৬টি স্টেশন ও টহল ফাঁড়ি থেকে জব্দ করা মালপত্রের আংশিক ভেসে গেছে। অবকাঠামো ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার বেশি।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, স্বাভাবিক সময়ে ২৪ ঘণ্টায় দুবার ভাটা এবং দুবার জোয়ারে প্লাবিত হয় সুন্দরবনের একটি অংশ। কিন্তু এবারই এত দীর্ঘ সময় পুরো বন তলিয়ে ছিল। জোয়ারের পানির উচ্চতাও ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট বেশি। বন বিভাগের কয়েকটি দল ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছে। বন্য প্রাণী ও অবকাঠামোর ক্ষতির পুরো চিত্র পেতে আরও সময় লাগবে।
সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ফাঁড়ির পুকুর ছাড়াও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে আমাদের আবাসস্থলের মধ্যে পানি উঠে গিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা টাকার অঙ্কে নিরূপণ সম্ভব নয়। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে।’
সুন্দরবনের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক বন্য প্রাণী মারা যাওয়ার কথা শুনতে পাচ্ছি। আমার স্টেশনের আওতাভুক্ত এলাকাগুলোতে এখনো কোনো জীবজন্তুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে বনের মধ্যের টহল ফাঁড়ির মিঠাপানির পুকুরগুলো উঁচু জোয়ারে লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে। সুন্দরবনে অবস্থান করা বনকর্মী, জেলে-বাওয়ালি, মৌয়াল ছাড়াও এই পুকুরের পানি পান করে বন্য প্রাণীরা। পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভেসে যাওয়ায় বনের প্রাণীরা পানিসংকটে পড়বে। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যেও এর প্রভাবে পড়বে।’
সুন্দরবনের ভেতরে মাছ ধরতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে আটকে পড়েছিলেন কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকার আলতাফ হোসেন (৪৫)। তিনি বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে খালে মাছ ধরতে গিয়ে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ায় ফিরতে পারেননি। বনের মধ্যে এত জোয়ারের পানি বাড়তে আগে কখনো দেখেননি, তার ওপর তীব্র বাতাস। ছোট খালের মধ্যেও ঢেউয়ের বাড়িতে নৌকা ভেঙে যাওয়ায় উপক্রম। মনে হচ্ছিল আর বেঁচে ফেরা হবে না। ঝড়ে গাছগুলো মট মট শব্দে ভেঙে পড়ছিল। চোখের সামনে দিয়ে পানিতে হরিণ ভেসে যেতে দেখেছেন তিনি।
সুন্দরবন এলাকার ওই জেলে বলেন, ঝড়ে নৌকায় থাকা খাওয়ার পানির পাত্র ভেসে যায় তাঁর। সাধারণত পানি ফুরিয়ে গেলে সুন্দরবনের ভেতরের পুকুর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন তাঁরা। এখন সেই পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে যাওয়ায় পানি পান ছাড়াই নৌকা বেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ফেরার পথে তিনি দেখেছেন, সুন্দরবনের অধিকাংশ জায়গায় গাছগুলো উল্টেপাল্টে গেছে। অনেক গাছের পাতা নেই।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব ঠেকিয়ে দিয়ে খুলনার কয়রা অঞ্চলকে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। তবে বনের ভেতর গাছপালা ও পশুপাখির ক্ষতি হয়েছে। গাছে গাছে অসংখ্য পাখির বাসা ছিল। যত ডিম ছিল, সেগুলো নষ্ট হয়েছে। সুন্দরবনের বন্য প্রাণীদের জন্য পর্যাপ্ত উঁচু টিলা ও শেল্টার রাখা জরুরি। সামনের দিনগুলোতে পশুপাখির পানির সংকট তৈরি হতে পারে, এ জন্য দ্রুত বনের ভেতরের লোনাপানিতে ভেসে যাওয়া পুকুরগুলো সেচে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। সামনে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি দিয়ে ভরতে হবে।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল ভদ্র বলেন, যুগ যুগ ধরে সুন্দরবন নিজের ক্ষতি মেনে নিয়ে মানুষকে রক্ষা করে আসছে। গত ১৭ বছরে কমপক্ষে ১৭টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে দেশের উপকূলে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে সুন্দরবনের প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর এলাকার গাছ পুরোপুরি এবং ৮০ হাজার হেক্টর এলাকার গাছ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় ৪০টি হরিণ, একটি বাঘ ও একটি তিমির মৃতদেহ পাওয়া যায়। এবার ঘূর্ণিঝড় রিমালেও নাকাল সুন্দরবন। ভেতরে যাই হোক, সুন্দরবন নিজে নিজেই বাঁচতে জানে। শুধু অত্যাচার না করলেই হয়।