মাটি ছাড়াই সবজির চারা উৎপাদন করে স্বাবলম্বী
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় মাটি ছাড়াই সবজির চারা উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন ফারুক হোসেন (৪০)। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারায় ফলন ভালো হয় ও সহজে চারা স্থানান্তর করা যায়।
ফারুকের বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের আগাচতরা গ্রামে। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।
পীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে প্লাস্টিকের ট্রে ও ছোট ছোট প্লাস্টিকের গ্লাস ব্যবহৃত হয়। মাটির পরিবর্তে ওই ট্রে ও গ্লাসে কচুরিপানা ও নারকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণ জীবাণুমুক্ত করে সেখানে সরাসরি সবজির বীজ রোপণ করতে হয়।
ওই পদ্ধতিতে শীতকালীন সবজি বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের চারা উৎপাদন করছেন ওই কৃষক।
কৃষক ফারুক হোসেন জানান, ইউটিউবে মাটি ছাড়াই সবজি চারা উৎপাদন পদ্ধতি দেখে উৎসাহিত হয়েছেন তিনি। ২০২০ সাল থেকে তিনি ওই পদ্ধতিতে সবজির চারা উৎপাদন করছেন।
ফারুকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালে একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশে ওই পদ্ধতিতে ৪০ হাজার সবজি চারা লাগান তিনি। তিন মাসে তা বিক্রি করে আয় করেন ৪০ হাজার টাকা। এর পরে আর থেমে থাকেননি তিনি। চলতি মৌসুমে গত ২৬ দিন আগে ২৫ শতক জায়গাজুড়ে ওই পদ্ধতিতে চার লাখ বিভিন্ন সবজির চারা লাগিয়েছেন তিনি। এতে তাঁর ব্যয় হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। ইতিমধ্যে চারা তুলে বিক্রি করেছেন প্রায় লাখ টাকার। তিনি আশা করছেন দেড় মাসের মধ্যে ওই চারা সাত লাখ টাকায় বিক্রির। এতে লাভ হবে অন্তত তিন লাখ টাকা।
ফারুক হোসেন বলেন, আগে অন্যের নার্সারি থেকে চারা কিনে বাজারে বিক্রি করতাম। তখন সংসারে অভাব লেগে থাকত, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটত। আমার আবাদি কোনো জমি নেই। দুই বছর আগে ওই ২৫ শতক জমি ১৫ হাজার টাকায় বাৎসরিক চুক্তিতে নিয়েছি। এখন স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে খেয়ে পরে অনায়াসে দিন কেটে যাচ্ছে। টিনের বাড়ি করেছি। প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা পুঁজিও রয়েছে।
ফারুক হোসেন জানান, সাধারণত নার্সারিতে এসেই ক্রেতারা চারা কিনে নিয়ে যান। কেউ খুচরা আবার কেউ পাইকারিতে চারা কেনেন। প্রতিটি চারা উৎপাদনে খরচ পড়ে প্রায় ১ টাকা ২০ পয়সা, তা বিক্রি করা হয় সর্বোচ্চ দুই টাকায়।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ফারুকের নার্সারিতে চারা কিনতে এসেছিলেন সোনাতলা গ্রামের আমজাদ হোসেন। এ সময় আমজাদ হোসেন বলেন, ১০ শতক জমিতে ফুলকপির চারা লাগানোর জন্য জমি প্রস্তুত করেছেন। গত বছর ফারুকের নার্সারির চারা কিনে লাগানোর পরে ভালো ফলন পেয়ে লাভ করেছেন। এর আগে মাটিতে লাগানো চারা ওই জমিতে রোপণ করে তেমন একটা ভালো ফলন পাননি। এ কারণে এবারও ফারুকের নার্সারিতে চারা কিনতে এসেছেন।
চারা উৎপাদনপদ্ধতি
নারকেলের ছোবড়া, গোবর, কচুরিপানাসহ প্রয়োজনীয় কিছু রাসায়নিক সার দিয়ে ১৫ দিন ঢেকে রাখতে হয়। ক্রমান্বয়ে তা পচে গেলে শুকিয়ে গুঁড়া করে পরিমাণমতো ট্রে ও গ্লাসে দিয়ে সবজি বীজ বপন করা হয়। ওই শুকনা গুঁড়াকে কোকোপিটের গুঁড়া বলা হয়ে থাকে। বীজ বপনের এক সপ্তাহের মধ্যে সেখান থেকে অঙ্কুর বের হয় এবং ২০-২২ দিন পরই চারা ৫-৬ ইঞ্চি হলে তা বিক্রির উপযোগী হয়। এ ছাড়া রংপুরের মডার্নমোড় এলাকায় বিভিন্ন নার্সারির মালিকেরা তৈরি কোকোপিট বিক্রি করছেন ২২ টাকা কেজি দরে। যে কেউ তা কিনে সহজে মাটি ছাড়াই সবজির চারা উৎপাদন করতে পারেন। তবে চারা সুরক্ষার জন্য ওপরে শেডনেট দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
পীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাদেকুজ্জামান সরকার বলেন, ওই পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি চারা মাটিবাহিত রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকায় সুস্থ ও সবল হয়। এতে মাটিতে উৎপাদিত চারার চেয়ে ফলনও অনেক বেশি হয়। কোকোপিট মাটির তুলনায় অনেক হালকা। এ কারণে চারা স্থানান্তরের সময়ে গাছের গোড়া আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। মাটি ছাড়া চারা উৎপাদনপদ্ধতি ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।