‘আমাগো আবার ঈদ। এমনি নুন আনতে পান্তা থাকে না, দিন চলে না, তারপর ঈদের আনন্দ মাটি করে দে গেছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। রিমাল আমাগো পথে বসাইয়ে দে গেছে।’
আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সুন্দরবন-সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৈখালী ইউনিয়নের ভদ্রখালী গ্রামের রিমালে ভেঙে যাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ৬০ বছর বয়সী ফজিলা বিবি এভাবে কথাগুলো বলেন।
ফজিলা বিবি আরও বলেন, ‘দুটি ঘর রিমাল মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে। রাত কাটানোর মতো জায়গা নেই। কোনো দিন খাওয়া জোটে আবার কোনো দিন জোটে না। প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠন ঘর মেরামতের জন্য ছয় হাজার টাকা দিয়েছে। তাতে কি কিছু হয়। এখন একপ্রকার খোলা আকাশের নিচে নাতনিকে নিয়ে রাত কাটাই। এলাকায় কাজ না থাকায় ছোট ছেলে ফজলু রহমান গাজী কাজের সন্ধানে চলে গেছে অন্য এলাকায়। এখন যেখানে বেঁচে থাকা কঠিন, সেখানে ঈদ আনন্দের কথা মাথায় আসে না। আজ ঈদের দিন আলু সেদ্ধ আর ভাত রান্না করে নাতনিরে দেব।’
ফজিলা বিবির প্রতিবেশী রোমেছা খাতুন ভারী গলায় বলেন, ‘ঈদ আমাগো জন্যি আর পাঁচটা দিনের মতো। ঈদ হলি কী, আর না হলিই-বা কী, কাজে না গিলি আমাগো পেটে দানাপানি পড়বে না।’ নিজেকে সামলে নিয়ে দুই সন্তানের জননী রোমেছা আরও বলেন, ‘এবারের ঈদ নে আমাগো অনেক আশা ছেলো। তবে এক মুহূর্তের ঘূর্ণিঝড় এসে আমাগো সব আশা ধুয়ে দে গেছে।’
পাশের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, একপ্রকার খোলা আকাশের নিচে উনুন চালিয়ে তাসলিমা খাতুন (৩৫) রান্না করছেন। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, গতকাল রোববার ক্লাব থেকে কয়টা চাল ও আলু দিয়ে গেছে, তা-ই সেদ্ধ করছেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের মা তাসলিমা বলেন, এ দিয়ে ঈদের দিন চালিয়ে দেবেন। ঈদ আনন্দ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাঁদের। ঝড়ে উড়ে যাওয়া ঘর চাল দেখিয়ে বললেন, উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ এসে দেখে গেছেন। বলেছেন একটা ব্যবস্থা হবে। প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠন ছয় হাজার টাকা দিয়েছে ঘর মেরামত করার জন্য। কিন্তু ঘর মেরামত করার জন্য লাগবে ৫০ হাজার টাকা। সামনে বর্ষাকাল, ঘর মেরামত করতে না পারলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
একই গ্রামের আবদুর রহমান (৭০) অসুস্থ। বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া মেয়েকে নিয়ে থাকেন। ঘূর্ণিঝড়ে ঘরের ছাউনি উড়ে গেছে। রান্নার জায়গা নেই। চাল জোগাড় করতে পারলে অন্যের বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে আসেন। আবদুর রহমানের মেয়ে আয়শা বিবি (৩৪) বলেন, এলাকায় কোনো কাজ নেই। এখানকার মানুষ সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরে তা বিক্রি করে জীবন চালায়। ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ। আবার ঘূর্ণিঝড় এ এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি সব ভেঙে সর্বস্বান্ত। এখন তাঁদের দিন চলছে না। সরকারি সহযোগিতা না পেলে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায় থাকবে না।
পাশের কুমারমারী গ্রামের বৃদ্ধ সাঈদ গাজী জানান, মাত্র তিন সপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া রিমালের তাণ্ডবে সর্বস্ব হারিয়ে উপকূলীয় এলাকার পরিবারগুলো এখন নিদারুণ অসহায়ত্বের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। রিমালের আঘাতে তাদের বসতঘর ধ্বংসের পাশাপাশি অসংখ্য চিংড়ির ঘের তলিয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম সমাগত হলেও এখন পর্যন্ত ঘর তোলার ব্যবস্থা করতে পারেননি। বেসরকারি সংস্থা বা সরকারি সহায়তা ছাড়া আবার বসতঘর গড়ে তোলা সম্ভব নয় জানিয়ে এসব গ্রামবাসী আরও বলেন, খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে দিন কাটানো মানুষদের জন্য ঈদ আনন্দ নয়।
অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহি বলেন, রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে এবারের ঈদ নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাসই নেই। সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। বেসরকারি সংস্থা প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠনসহ কয়েকটি সংস্থা কিছু পরিবারকে সহযোগিতা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। জরুরি ভিত্তিতে সরকারি উদ্যোগও দরকার।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজিবুল আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম আতাউল হক বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কিছু পরিবারকে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। প্রেরণা নামের একটি নারী সংগঠন দুই শতাধিক পরিবারকে শ্যামনগরে ছয় হাজার করে টাকা দিয়েছে। আর সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে সহযোগিতা পেলে তাঁদের দেওয়া হবে।