ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়ার আগে টিউশনি করাতে হতো তাজমীর। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে বাড়িতে ফিরে আবারও টিউশনি করেছে সে। তারপর নিজের পড়াশোনা। তাজমীর মতো সংগ্রাম করেছে শ্রাবন্তী কর্মকার, রিকেল চাকমা ও ইয়াসিন রহমান। তারা প্রত্যেকেই দারিদ্র্যকে হারিয়ে আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছে। পড়াশোনা শেষে তাদের কেউ হতে চায় চিকিৎসক, কেউ আবার শিক্ষক।
অদম্য মেধাবী এই শিক্ষার্থীরা এবার দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের সবার চোখে স্বপ্ন। কিন্তু আর্থিক অনটনে উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাদের মনে আছে সংশয়।
টিউশনি করে পড়েছে তাজমী
দারিদ্র্যের কারণে নবম শ্রেণি থেকে সকাল-বিকেল টিউশনি করেছে তাজমী আক্তারী সুলতানা। টিউশনির পর নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ফরিদপুর হালিমা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
তাজমীরা ফরিদপুর শহরের গোপালপুর মহল্লার একটি টিনের ভাড়া বাড়িতে বসবাস করে। তাদের গ্রামের বাড়ি মধুখালী উপজেলার বড় গোপালদী গ্রামে। বাড়িতে চাষযোগ্য জমি না থাকায় ১০ বছর আগে শহরে চলে আসেন তাজমীর বাবা কাওসার মল্লিক।
ফরিদপুর হালিমা বালিকা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম মো. বদরুদ্দোজা বলেন, তাজমী খুবই পরিশ্রমী ও মেধাবী শিক্ষার্থী। সে ডাক্তার হতে চায়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের জন্য পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করা কঠিন।
দমেনি শ্রাবন্তীর ইচ্ছাশক্তি
পানের দোকানদার বাবা বিজয় কর্মকারের সামান্য আয়ে চলে টানাপোড়েনের সংসার। দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাতে সাত বছর আগে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন তিনি। দারিদ্র্যের কারণে বসবাস করেন এক কক্ষবিশিষ্ট ভাড়া বাসায়। তবু শ্রাবন্তী কর্মকারকে দমানো যায়নি। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
শ্রাবন্তীদের গ্রামের বাড়ি উখিয়ার বালুখালী গ্রামে। বর্তমানে কক্সবাজারের ঘোনারপাড়া এলাকায় বসবাস করে। শ্রাবন্তীর বাবা বিজয় কর্মকার বলেন, ‘অনলাইন নিবন্ধনে মেয়ের (শ্রাবন্তীর) ভাগ্যে জুটেছে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ। ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে কলেজে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু কীভাবে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
শ্রাবন্তী জানায়, লেখাপড়া করে সে চিকিৎসক হতে চায়। গত এক বছর নিজে পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ মিটিয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও সহযোগিতা করেছেন।
কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদা মোর্শেদা আইভি বলেন, শ্রাবন্তী অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে। অর্থসহায়তা না পেলে মেয়েটির ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে।
শিক্ষক হতে চায় রিকেল
দিনমজুর বাবার আয় দিয়ে চার সদস্যের খাবারের খরচ মেটাতে হয়। তাই পড়ার খরচ জোগাতে টিউশনি করত রিকেল চাকমা। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের ফলে রাঙামাটির সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের বড়াদম সুরবালা স্মৃতি বিদ্যাপীঠের ব্যবসা বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতা করতে চায় রিকেল।
রিকেল রাঙামাটির সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের প্রত্যন্ত কেরেটকাটা গ্রামের বিজুরেশ চাকমা ও লক্ষ্মীদেবী চাকমার সন্তান। রিকেলদের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অন্তত ১৫ কিলোমিটার। কিছু পথ হেঁটে ও নৌকায় করে স্কুলে যেতে হতো তার। রিকেল বলে, ‘ইচ্ছা ছিল ঢাকা বা চট্টগ্রামের ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থার কারণে স্থানীয় তিনটি কলেজে আবেদন করেছি।’
বড়াদম সুরবালা স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক অরুণ কান্তি চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, রিকেল চাকমার বাবা একজন দিনমজুর। ছেলেকে পড়াশোনা করার সামর্থ্য তাঁর নেই। রিকেল চাকমা পড়াশোনায় খুবই ভালো। ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম করে তাদের বিদ্যালয় থেকে শুধু সে-ই জিপিএ-৫ পেয়েছে।
পড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ইয়াসিন
টানাপোড়েনের সংসারে ইয়াসিন রহমানের পড়ালেখার খরচ দিতে পারেন না বাবা নাসির উদ্দিন আকন্দ। বন্ধুদের সবাই যখন পছন্দের কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন কলেজে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় সে। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধানঘরা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ইয়াসিন। তবে কলেজে পড়াশোনার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে সে।
ইয়াসিন রায়গঞ্জ পৌরসভার রণতিথা এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন আকন্দ ও গৃহিণী সালমা বেগম দম্পতির ছেলে। ইয়াসিনের ছোট ভাই স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। ইয়াসিন বলে, ‘পড়ালেখা করে ভালো মানুষ হতে চাই। তবে কলেজে পড়ালেখা করার জন্য কেউ একটু সহায়তা করলে অনেক উপকার হতো।’
ইয়াসিনের বাবা ধানগড়া বাজারে মাংস বিক্রির কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘যে টাকা রোজগার করি, তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ দেব কীভাবে?’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন, প্রবীর কান্তি বালা, ফরিদপুর; আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার; সাধন বিকাশ চাকমা, রাঙামাটি; সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ]