গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে আছে মোগল আমলের নিদর্শন, বাড়িও তৈরি সেই আমলের ইটে

কয়রা উপজেল বড়বাড়ি গ্রামের বাড়িঘরের আশপাশে পড়ে আছে পুরোনো আমলের নকশাখচিত পাথর। বুধবার সকালে বড়বাড়ি গ্রামের উপেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়ির উঠানেছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা সবুজ–শ্যামল ছবির মতো গ্রাম ‘বড়বাড়ি’। গ্রামের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ৫০০ বছরের ইতিহাস। সেখানকার মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যায় পুরোনো আমলের পুরাকীর্তির ভগ্নাংশ, প্রত্নতাত্ত্বিক নকশা করা পাথর আর অমূল্য সব ইট। যেগুলোকে ইতিহাসবিদদেরা মোগল আমলের রাজা প্রতাপাদিত্যের দুর্গের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

খুলনার কয়রা উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে বড়বাড়ি গ্রামের অবস্থান।  ‘কয়রা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নামক বইয়ে কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আ ব ম আবদুল মালেক লিখেছেন, মোগল আমলে বারভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপশালী রাজা প্রতাপাদিত্য আনুমানিক ১৫৮৭-৯৫ সালে বড়বাড়ি গ্রামে দুর্গ ও শিবমন্দির নির্মাণ করেন। দুর্গের চারদিকের প্রাচীরের ভেতরে ছিল বড় বড় সুরম্য প্রাসাদ। রাজা প্রতাপাদিত্যের পাশাপাশি তাঁর চাচা বসন্ত রায় ও তাঁর ছেলে কচু রায়ও বড়বাড়ি গ্রামে এসেছিলেন। বড়বাড়ির শিলপুকুর, পদ্মপুকুর, দুই সতীনের পুকুরসহ দুর্গের প্রাচীন ইট–পাথরের খণ্ডগুলো আজও গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

সরেজমিনে বড়বাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় স্তূপ আকারে রাখা পুরোনো আমলের সব ইট। রয়েছে নানা রকমের নকশা বা খোদাই করা ছোট-বড় পাথর। কোনো কোনো পাথরের ওজন প্রায় ১০০ কেজি। কিছু পাথরে বিভিন্ন ধরনের নকশা করা। বড়বাড়ি এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ি সেই পুরোনো আমলের ইট দিয়ে তৈরি করা। মাটি খুঁড়ে এসব ইট সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়েই ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে বলে জানালেন গ্রামের বাসিন্দারা।

কয়রার বড়বাড়ি গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে প্রাচীন ইট। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বড়বাড়ি গ্রামের মূল সড়কের পাশেই শিলপুকুর। পুকুরের পূর্ব পাড়ে একটি মন্দির ও বেশ কয়েকটি বাড়িঘর। মন্দিরের সামনে বসে ছিলেন বৃদ্ধ বানিকান্ত মণ্ডল। তিনি বললেন, ‘এই গ্রামের সবখানে পুরোনো আমলের ইট-পাথর আছে। আমার ঘরটাও ওই ইট দিয়ে বানাইছি। আর ওই যে শিল পুকুরদেখিছেন, আমরা শুনিছি, আগে পুকুরে পানির ওপর শিলাপাথর ভাইসে থাকত।’

শিলপুকুরপাড়ের কয়েকটি বাড়িঘরের আশপাশ ঘুরে প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে সামনে এগোলেই চোখে পড়ে এলাকার সবচেয়ে প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জ্যোতিষ চন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি। রাজা প্রতাপাদিত্যের দুর্গের সীমানাপ্রাচীরের মধ্যেই সাতপুরুষ ধরে বসবাস করছেন বলে জানালেন তিনি।

জ্যোতিষ চন্দ্র বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, এখানকার চারপাশে সাড়ে পাঁচ হাত চওড়া ইটের প্রাচীর ছিল। প্রাচীরের ৫০ ফুট পরপর একটি করে গম্বুজওয়ালা উঁচু মিনারের নমুনাও ছিল। প্রায় সাড়ে তিন শ বিঘা এলাকাজুড়ে ছিল প্রতাপাদিত্যের দুর্গটি। আমার বাড়ির আঙিনা, চাষের জমি কিংবা পুকুরঘাট সর্বত্রই আছে সেই আমলের ইট।’

জমিতে চাষ করার সময় এই পাথরের পিঁড়ি পাওয়া যায়। বুধবার সকালে বড়বাড়ি গ্রামের স্কুলশিক্ষক দেবী রঞ্জন সরকারের বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

গ্রামের তিনটি পুকুরের বিষয়ে জ্যোতিষ চন্দ্র আরও বলেন, এখানে মোগল আমলের তিনটি পুকুর আছে। শিলপুকুর ছাড়াও পদ্মপুকুরে ছিল পদ্মগাছে ভরা। দুই সতীনের পুকুরের নামকরণ সম্বন্ধে জানা যায়, রাজার দুই স্ত্রীর জন্য পুকুরটিতে দুটি পৃথক ঘাট ছিল। এ কারণে নামকরণ হয় দুই সতীনের পুকুর। বড়বাড়ির গ্রামের পূর্ব পাশে রাজা প্রতাপাদিত্যেরের নৌবাহিনী থাকত।

জ্যোতিষ চন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগোলে বড়বাড়ি গ্রামের উপেন্দ্রনাথ সরকার ও প্রভাষ মণ্ডলের বাড়ির সামনে সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি নকশাখচিত পাথর পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রভাষ মণ্ডল জানালেন, ‘এসব পাথর বাড়ির পুকুর খনন করার সময় পেয়েছি। একবার একটি পাথরের নৌকাও পেয়েছিলাম। এখানকার মাটি খুঁড়লে ইটের গাঁথুনিযুক্ত প্রাচীর এবং অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ এখনো পাওয়া যায়।’

স্থানীয় লোকজন বিষয়টির গুরুত্ব না বুঝে যাচ্ছেতাইভাবে খনন করে ইট, দেয়াল ও পাথর তুলে নিচ্ছেন। বড়বাড়ির ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক।
বিদেশ রঞ্জন মৃধা, সভাপতি, কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি

গ্রামের স্কুলশিক্ষক দেবী রঞ্জন সরকারের বাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে পুরোনো আমলের নকশাখচিত বড় বড় আরও পাথর। তিনি বললেন, এগুলো জমিতে চাষ করার সময় পেয়েছেন। গ্রামের মানুষ মাটির নিচ থেকে মাটি ও পাথরের নানা তৈজসপত্র পেয়েছেন। তিনি ঘরের মধ্যে থেকে নিয়ে এসে দেখালেন আরও কয়েকটি নকশা করা ছোট পাথর, একটি পাথরের গোলাকার পিঁড়ি ও পাথরের ওপর খোদাই করা গণেশের মূর্তি।

বড়বাড়ি গ্রামের পুরোনো ইতিহাসের ধারণা পাওয়া যায় সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রতাপাদিত্যের দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখনো বর্তমান। স্থানীয় লোকেরা এই দুর্গকে বড়বাড়ি বলে। স্থানে স্থানে সু-উচ্চ গৃহগুলোর ভগ্নাবশেষ স্তূপ একতলা বাড়ির মতো উচ্চ রহিয়াছে। দুর্গের চারপাশে পরিখা আছে। দুর্গের মধ্যে তিনটি পুকুর আছে। দুর্গের বাইরে উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গের মন্দিরসহ অন্যান্য মন্দির ছিল। সমগ্র বড়বাড়িজুড়ে রয়েছে সে আমলের রাশি রাশি ইট।’

পুকুর খননের সময় পাথরের ওপর খোদাই করা গণেশের মূর্তিটি পাওয়া যায়। বুধবার সকালে বড়বাড়ি গ্রামের স্কুলশিক্ষক দেবী রঞ্জন সরকারের বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণে উদ্যোগ না থাকায় আক্ষেপের কথা জানালেন কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা। তিনি বলেন, ‘এত বড় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বিষয়টির গুরুত্ব না বুঝে যাচ্ছেতাইভাবে খনন করে ইট, দেয়াল ও পাথর তুলে নিচ্ছেন। বড়বাড়ির ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। এটি খনন করে সঠিক ইতিহাস উদ্‌ঘাটন করা প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের উচিত স্থাপনাটি সংরক্ষণ করা। এতে পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মুক্ত হবে।’

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজে বড়বাড়ি গ্রাম পরিদর্শনে যাব। অভিজ্ঞ লোকদের সঙ্গে কথা বলব। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানটি কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আলাপ করে ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে যা করা দরকার, সবই করা হবে।’