আগুন নেভাতে জীবন দিয়েছিলেন, সেই ১৩ ‘অগ্নিবীরকে’ নিয়ে দেয়ালচিত্র

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে নিহতদের স্মরণে দেয়াল চিত্র উদ্বোধন করা হয়। গত সোমবার দুপুরে কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন এলাকায়প্রথম আলো

চট্টগ্রামের কুমিরা ও সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের দেওয়ালে সাঁটানো হয়েছে দুটি ফ্রেম। একটিতে আটটি মুখ। অপরটিতে পাঁচটি। কাঠের ফ্রেমে কাচ দিয়ে বাঁধাই করা ছবির মুখগুলো এখন স্মৃতি। ২০২২ সালের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে নিহত হন ফায়ার সার্ভিসের এই ১৩ সদস্য। স্টেশনের দেয়ালচিত্রে স্থান পেয়েছে তাঁদেরই ছবি।

গত সোমবার এই দুই স্টেশনে দেয়ালচিত্র উদ্বোধন করেন ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপপরিচালক দিনমণি শর্মা। এই সময়ে ফায়ার সার্ভিসের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের সময় নিহত ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সম্মান জানান ওই দুই স্টেশনে কর্মরত কর্মীরা।

এ বিষয়ে দিনমণি শর্মা বলেন, শুরুতেই দুই স্টেশনের প্রধানকে নিহত ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের ছবি সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেন তিনি। সদস্যদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ই–মেইলের মাধ্যমে তাঁদের ছবিগুলো সংগ্রহ করেন তাঁরা। পরে সেগুলো ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়ালচিত্র তৈরি করিয়ে আনা হয়।

দুর্ঘটনার আড়াই বছর পর  বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের পাঁচজন সদস্য ও কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের আটজন সদস্যের ছবি স্টেশনে লাগানো হয়েছে। দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নিহত এই ১৩ জনকে ‘অগ্নিবীর’ উপাধি দেওয়া হয়। সে সময় আহত হন দুই স্টেশনের ১৫ সদস্য।

সরেজমিনে কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, স্টেশনটির কার্যালয়ের সামনের গাড়ি রাখার স্থানের দেয়ালে নিহত অগ্নিবীরদের স্মরণে তৈরি করা দেয়ালচিত্র সাঁটানো হয়েছে। একটি ফ্রেমের ভেতরে আটজন নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মীর ইউনিফর্ম পরিহিত ছবি। প্রথম সারিতে পাশাপাশি দুটি ও নিচের দুটি সারিতে তিনটি করে ছবি বসানো হয়েছে। ফ্রেমটির ওপরে লেখা ‘কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের আট অগ্নিবীর’। প্রতিটি ছবির নিচে রয়েছে নিহত ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের নাম। ফ্রেমের একেবারে নিচের দিকে লেখা রয়েছে আমরা তোমাদের ভুলব না। এ ছাড়া স্টেশনটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কক্ষের দক্ষিণ পাশের দেয়ালেও একই রকম দেয়ালচিত্র সাঁটানো হয়েছে।

কথা হয় কুমিরা স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আল মামুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপোর বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। সেদিনের ঘটনায় এই স্টেশনের আটজন ও সীতাকুণ্ড স্টেশনের পাঁচজনসহ মোট ১৩ কর্মী নিহত হয়েছিলেন। দুর্ঘটনার আড়াই বছর পরও নিহত কর্মীদের স্মরণ করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছিল না। তাঁদের স্মৃতি হারিয়ে যেতে বসেছিল। বর্তমান মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ২৪ অক্টোবর সীতাকুণ্ড এবং কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন পরিদর্শন করেন। ওই সময় তিনি বিএম কনটেইনার ডিপোতে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দেয়ালচিত্র তৈরির জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন।

ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন তৎকালীন কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ। তিনি এখন হবিগঞ্জ সদর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। গতকাল মঙ্গলবার সকালে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন মহাপরিচালক বিস্ফোরণে নিহত অগ্নিবীদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা আর হয়নি। দেয়ালচিত্র স্থাপনের কথা শুনে তিনি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। বিএম কনটেইনার ডিপোতে তিনি তাঁর ডান হাত ভেঙেছেন। এখনো সেখানে ক্লিপ লাগানো। তাঁর নেতৃত্বেই সেখানে প্রথম আগুন নির্বাপণে কাজ শুরু হয়। অথচ তিনি এ কাজের কোনো স্বীকৃতি পাননি। তবে তাঁর ছয় সহকর্মীকে পদক দেওয়ায় তিনি খুশি। প্রতিটি ফায়ার সার্ভিস সদস্যের কমপক্ষে দুটি করে ইউনিফর্ম থাকে। দুর্ঘটনায় নিহত সদস্যদের একটি করে ইউনিফর্ম স্টেশন কিংবা তাঁদের বাড়িতে ছিল। তিনি সেগুলো সংগ্রহ করেছেন। নিহত সদস্যদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংগ্রহ করে একটি শোকেস তৈরির ইচ্ছার কথা জানান তিনি। এতে ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান সদস্যরা নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করার পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্ব পালনে উৎসাহ পাবেন বলে মনে করেন তিনি।

সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা নুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী। তাঁর স্টেশনেও দেয়াল ছবি করা হয়েছে। দুই স্টেশনে ১৩ জন নিহত ব্যক্তির মধ্যে তিনজনের লাশ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মোট ৫১ জন নিহত ও দুই শতাধিক লোক আহত হন। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য নিহত হন ১৩ জন, আহত হন অন্তত ১৫ জন।