জোর বেশি যাঁর, ওএমএসের চাল তাঁর
সোমবার বেলা ১১টা! কুষ্টিয়া শহরের ছয়রাস্তা মোড় এলাকায় ছোট্ট একটি দোকানের সামনে শতাধিক নারী-পুরুষের জটলা। তাঁরা সবাই খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) চাল ও আটা কিনতে এসেছেন। অধিকাংশই বৃদ্ধ।
ভিড় ঠেলে শক্তি প্রয়োগ করে যাঁরা সামনে যেতে পারছেন, তাঁরাই জয়ী হচ্ছেন। অনেকে ভিড়ের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। তবু সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন চাল-আটা কিনতে। সোমবার সকালে এমন ভিড় চোখে পড়ল।
সকালে লাইন থাকলেও বিক্রি শুরু হওয়ার পর বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় বলে জানালেন ওএমএসের ডিলার পিন্টু খন্দকার। অসহায়ত্ব প্রকাশ পেল তাঁর কথায়, সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন তিনি ৬০০ কেজি করে চাল ও আটা পান। মাত্র ১২০ জনের কাছে বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু চাল-আটা কিনতে অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ জন মানুষ জড়ো হন। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টায় বিক্রি শেষ হয়ে যায়। অনেকে না পেয়ে ফিরে যান।
থানাপাড়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ মাজেদা খাতুন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সকাল সাতটায় আসছি। আমাক দেচ্চে না। খালি ফ্যালা ফ্যালা দ্যাচ্চে। কাল (রোববার) আইসি ফেরত গেচি, দেয় নাই। বুইড়ি মানুষ পারিনি ভিড় ঠেইলি ভিতরে যাতি। আজ আবার আইচি। পাব কি না জানি নে।’ তিনি জানালেন, ৩ ছেলে ও ছেলেদের সংসার মিলে পরিবারে ১০ জন সদস্য। ছেলেরা বাজারে তরকারি বিক্রি করে। কম দামে চাল-আটা কিনলে ভালো হয়। এ জন্য দুদিন ধরে ডিলার পয়েন্টে আসছেন। জোর করি যে সামনে যেতে পারে, সেই চাল-আটা পায়। শরীরে শক্তি নাই, তাই সামনে যেতে পারেন না।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক নারী-পুরুষ জানান, তাঁদের বেশির ভাগই সকাল ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে চলে আসেন। তখন থেকে লাইনে ওএমএসের পণ্যের জন্য অপেক্ষা করেন। নির্ধারিত ওই স্থানে সকাল নয়টার দিকে দোকান খোলা হলে সবাই একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। যে বেশি জোর খাটাতে পারে, সেই জয়ী হয়।
সেখান থেকে চাল ও আটা কেনেন থানাপাড়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ জরিনা খাতুন। চাল-আটা কেনার পর বললেন, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আসেন। চার ঘণ্টা পর ভিড়ের মধ্যে পড়ে ধাক্কা খেতে খেতে একপর্যায়ে কিনতে পারেন। এতে শরীরে আঘাতও পান।
থানাপাড়ার বাসিন্দা গোলাপী খাতুন এসেছিলেন তাঁর ৫ বছর বয়সী ছেলে জুবায়েরকে নিয়ে। লাইনে দাঁড়ানোর একপর্যায়ে সব বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে ছেলেও পড়ে যায়। পাঁচ ঘণ্টা পর ৫ কেজি চাল ও ৩ কেজি আটা কিনতে পারেন। তিনি ভিড় মাড়িয়ে বাইরে বের হন। এ সময় ছেলেটি কাঁদছিল। চাল-আটার থলে পাশে রেখে ছেলেকে আদর করতে থাকেন। নিজেও হাঁফাচ্ছিলেন।
ছয়রাস্তা মোড় এলাকায় ওএমএসের লাইনের আশপাশে এক ঘণ্টা থেকে দেখা গেল, দোকানের সামনে কোনো লাইন কিংবা শৃঙ্খলা নেই। এক পরিবারের একজন সদস্য পণ্য কেনার কথা থাকলেও তা দেখার কিংবা তদারকির কোনো সুযোগ নেই। এক পরিবারের একাধিক সদস্য পণ্য কেনার অভিযোগ পাওয়া গেল লাইনে দাঁড়ানো মানুষের কাছ থেকে। আবার কেউ কেউ অন্য ডিলারের কাছ থেকে চাল-আটা কেনার পর এখানে এসে আবার লাইনে দাঁড়িয়েছেন। টিপ সইয়ের চিহ্ন দেখা গেল এক নারীর হাতে। ভিড় ঠেলে বিক্রেতার দিকে একাধিক নারী হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সবার উদ্দেশ্য আগে পণ্য কেনা। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। দুপুর ১২টার মিনিট কয়েক পর ডিলার দোকান বন্ধ করে চলে যান। যদিও বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বিক্রির সময় ছিল। কিন্তু বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হন তিনি।
এই ডিলার পয়েন্টে তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন কুষ্টিয়া খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তা অনিক মজুমদার। তিনি জানালেন, সকালে দোকান খোলার আগে লাইনে শৃঙ্খলা ছিল। কিন্তু বিক্রি শুরু হওয়ার পর বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। বরাদ্দের তুলনায় বেশি মানুষ জড়ো হয়। এ জন্য এমনটি হয়।
কুষ্টিয়া খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ডে ২০ জন ডিলার চাল-আটা বিক্রি করেন। একজন ডিলার সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন ৬০০ কেজি চাল ও আটা বরাদ্দ পান। একজন ব্যক্তি ৫ কেজি করে চাল ও আটা কিনতে পারেন। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডিলাররা ৫ কেজি করে চাল দিলেও আটা দেন ৩ কেজি করে। প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা ও আটা ২৪ টাকা দরে বিক্রি হয়।