বিনা বেতনের বিদ্যালয়টিতে দূরের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় সাইকেলও

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির তৌহিদুল আনোয়ার হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় সাইকেলও। সম্প্রতি বিদ্যালয় প্রঙ্গণেপ্রথম আলো

বিনা বেতনের বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের পোশাক দেওয়া হয় বিদ্যালয় থেকে। কেবল তা–ই নয়, দূরের শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেলও দেওয়া হয়। এমন বিদ্যালয়ের দেখা মিলবে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সুয়াবিল ইউনিয়নের বারোমাসিয়া গ্রামে।

বিদ্যালয়ের কথা শুরুর আগে বারোমাসিয়া গ্রাম সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। প্রত্যন্ত জনপদ। আশপাশে কোনো উচ্চবিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষার পরেই থেমে যেত এখানকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবন। ২০২০ সালে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বদলে যায় বারোমাসিয়া গ্রামসহ আশপাশের পাঁচ গ্রামের দৃশ্যপট।

বিনা বেতনের এই বিদ্যালয়ের নাম তৌহিদুল আনোয়ার হাইস্কুল। ভিন্ন ধরনের পাঠদান ব্যবস্থা, খেলাধুলা আর সাহিত্য–সংস্কৃতিতে জোর দেওয়া হয় এখানে। এসবের জন্য আছেন আলাদা শিক্ষকও। দিন কয়েক আগের এক সকালে বারোমাসিয়া গ্রামে গেলে চোখে পড়ে সার বেঁধে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী। কেউ কেউ সাইকেলে চেপেও যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের দিকে যাত্রা করা শিক্ষার্থীরাই জানাল, বিদ্যালয় থেকে সাইকেল দেওয়া হয় তাদের। দূরে থাকে, এমন ৪০ জন শিক্ষার্থী এবার সাইকেল পেয়েছে।

সম্প্রতি বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখা যায়, কোলাহলমুক্ত সবুজ ক্যাম্পাসে দৌড়ে বেড়াচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এক পাশে প্রশিক্ষকের কাছে কারাতে শিখছে একদল মেয়ে শিক্ষার্থী। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলার হলরুমের দিকে পা বাড়াতেই কানে ভেসে আসে শিক্ষার্থীদের সমবেত সংগীতের সুর।

পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলার ওপর জোর দেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে কারাতে শিখছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির তৌহিদুল আনোয়ার হাই স্কুলে
প্রথম আলো

যা যা আছে বিদ্যালয়ে

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য, শিক্ষক ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ফটিকছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ এ জনপদ ছিল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। আশপাশে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় প্রাথমিকেই থেমে যেত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে এ জনপদকে আলোকিত করতে আহমেদ শামসুল আনোয়ার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে তৌহিদুল আনোয়ার হাইস্কুল নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। দেড় একরের বেশি জায়গায় সুবিশাল ক্যাম্পাসে চারতলা ভবনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে শুরু করে নানা কার্যক্রম। ব্যবসায়, মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগের ৬১৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কম্পিউটার, সংগীত, সাহিত্য, ক্রীড়াসহ বিষয়ভিত্তিক ২২ জন শিক্ষক রয়েছেন বিদ্যালয়টিতে। ৩০টি কম্পিউটার–সংবলিত সুবিশাল ল্যাব, সাড়ে তিন হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, সততা স্টোর, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, ছবির গ্যালারিসহ নানা ব্যতিক্রমী আয়োজন এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশ এগিয়ে রেখেছে।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সুজাউদ্দিন জাফর বলেন, দারিদ্র্যপীড়িত এ এলাকাটি এমন আধুনিক সময়েও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। তখন স্থানীয় কিছু শিক্ষানুরাগী আহমেদ শামসুল আনোয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এখানে তৌহিদুল আনোয়ার হাইস্কুলটি স্থাপন করেন। শুরু থেকেই এ বিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়াশোনা করানো হয় শিক্ষার্থীদের। বই-খাতা ও জুতা–পোশাকের পাশাপাশি দূরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছে বাইসাইকেলের।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিয়মিত গ্রামে গ্রামে গিয়ে সচেতনতামূলক সভা করেন
প্রথম আলো

জনপদজুড়েই কর্মকাণ্ড

বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড কেবল এর চার দেয়ালেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং বলা যায় জনপদজুড়েই চলে কার্যক্রম। বিদ্যালয়টিতে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাদক ও মুঠোফোনে আসক্তি এবং বাল্যবিবাহবিরোধী সভার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া পাড়ায় পাড়ায় গিয়েও বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিয়মিত এসব নিয়ে সভার আয়োজন করেন। এমন বহুমুখী চেষ্টায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এই অঞ্চলের মানুষের মানসিকতাও বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক কাউছার বেগম বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর চা–শ্রমিকদের অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। এ বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের মতো আমরাও শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ বদলানোর ব্রত নিয়ে এখানে এসেছি। যত্নে রত্ন মেলে কথাটির সত্যতা পাচ্ছি এখানে। ২০২৩ সালে প্রথমবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শতভাগ পাস করেছে। এবার বিদ্যালয় থেকে ৫৪ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। আশা করছি এবারও সব শিক্ষার্থী কৃতকার্য হবে।’

বিদ্যালয়ে ঢুকলেই শোনা যায় সমবেত সংগীতের সুর
প্রথম আলো

পড়াশোনার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও সাহিত্য, শরীরচর্চা, কারাতে, সংগীত, নৃত্য, স্কাউটিংসহ সব বিভাগে দক্ষতা অর্জন করতে হয় শিক্ষার্থীদের। এ জন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় জাতীয় পরিসরেও সাফল্য দেখিয়েছে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

ফটিকছড়ি উপজেলার বারোমাসিয়া গ্রামে স্থাপিত তৌহিদুল আনোয়ার হাইস্কুলের বিষয়ে ফটিকছড়ি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সেলিম রাজা বলেন, ট্রাস্টের অধীন পরিচালিত তৌহিদুল আনোয়ার হাইস্কুল পাঠদানের অনুমতি পেলেও এখনো স্বীকৃতি পায়নি। প্রতিষ্ঠানটি নির্বাহী কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সরকারি বাধ্যবাধকতার বাইরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা যায় বলে নিয়মিত পাঠদানের বাইরেও খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজরকাড়া সাফল্য দেখাচ্ছে। বিদ্যালয়টি স্থাপনের পর দারিদ্র্যপীড়িত প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে শিক্ষার পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনেরও ছোঁয়া লেগেছে।