ঠিকানা যখন হক টাওয়ার

ত্রাণ বিতরণ তদারক করছেন ইমন উল হক (ডানে)। গতকাল দুপুরে ফেনী সদরের মিজান রোডের হক টাওয়ারেছবি: জুয়েল শীল

খিচুড়ি রান্না ও প্যাকেট করার কাজ চলছিল সমানতালে। কেউ পেঁয়াজ কাটছিলেন, কেউ গুনে গুনে প্যাকেট ভরছিলেন বস্তায়। আবার একটা দল রওনা দিচ্ছিল দুর্গম গ্রামের দিকে। তাঁরা সবাই স্বেচ্ছাসেবক। সাত দিন ধরে চলছে এ কর্মযজ্ঞ।

গতকাল বুধবার বেলা তখন সাড়ে ১১টা। এই ব্যস্ত স্বেচ্ছাসেবকদের দেখা মিলল ফেনী সদরের মিজান রোডের হক টাওয়ারে। কখনো বুকসমান, কখনো কোমরপানি মাড়িয়ে বন্যাকবলিত মানুষের কাছে খাবার, পানি, ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। আবার আটকে পড়া দুর্গম মানুষকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ে।

একজন, দুজন নয়; ৫০ জনের একটা দল ২২ আগস্ট নাওয়া–খাওয়া ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর টানা সাত দিন ধরে ফেনী জেলার গ্রামগুলো চষে বেড়িয়েছে তারা। যেখানে ডুবে যাওয়ার ভয় ছিল, সেখানে নৌকা নিয়ে গেছে।

হক টাওয়ারের কর্ণধার ব্যবসায়ী ইমন উল হক। তাঁর বাবা প্রয়াত সাংবাদিক ও ক্রীড়া সংগঠক মাহবুব উল হক ওরফে পেয়ারা। বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে ‘মাহবুব উল হক পেয়ারা ফাউন্ডেশন’ চালু করা হয়। সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম হয় এই ‘হক টাওয়ারে’। দীর্ঘদিন ধরেই সংগঠনটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায়ও পাঁচ হাজার মানুষকে শুকনো খাবার, খিচুড়ি, ডিম ও পানি দেওয়া হয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে সাত শতাধিক বন্যাকবলিত মানুষ ও তিন শ স্বেচ্ছাসেবকের। কর্মযজ্ঞ এখনো চলছে। সব কার্যক্রম হয়েছে হক টাওয়ার ঘিরে।

গতকাল হক টাওয়ারে গিয়ে দেখা গেল, ১০ তলা ভবন ঘিরে কয়েক শ মানুষের ভিড়। স্বেচ্ছাসেবকেরা ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট-বড় বেশ কিছু ট্রাক। কোনোটি ছাগলনাইয়া, কোনোটি দাগনভূঞার দিকে ছেড়ে যাচ্ছিল।

স্বেচ্ছাসেবীদের আশ্রয়স্থল

তাসফিক হকের নেতৃত্বে ২২ সদস্যের একটা দল ফেনী সদরের বিভিন্ন দুর্গম গ্রামে ত্রাণ বিতরণ করেছে। ২২ থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত তাঁরা গ্রামে গ্রামে বিচরণ করে ত্রাণ বিতরণ করেন। আটকে পড়াদের উদ্ধার করেন। দলটি এসেছিল ময়মনসিংহ থেকে। কিন্তু হোটেল না পাওয়ায় তাঁদের ঠিকানা হয় হক টাওয়ার।

তাসফিক প্রথম আলোকে বলেন, ফেনীর এক বন্ধু হক টাওয়ারের স্বত্বাধিকারী ইমন উল হকের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখান। তিনি সেখানে লিখেছিলেন, ত্রাণ দিতে এসে কেউ আটকে গেলে হক টাওয়ারে থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বিনা মূল্যে যেকোনো স্বেচ্ছাসেবক থাকতে পারবেন।

তাসফিক জানালেন, আটকে যাওয়ার পর ইমন উল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। মুঠোফোনে এসব কথা বলেন তিনি।

অবশ্য শুধু থাকার জায়গা নয়, দুর্গম গ্রামে যাওয়ার জন্য ট্রাক ও নৌকার ব্যবস্থা রাখা হয় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।

এবারের মতো বন্যা ফেনীতে আগে হয়নি। গ্রামের পর গ্রাম ডুবেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল ও মানুষ। ভেঙে পড়েছে ঘরবাড়ি। উপড়ে গেছে বিদ্যুতের খুঁটি, বড় বড় গাছ। জেলা প্রশাসন বলছে, আট লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ হয়েছে ঠিকানাহীন। বিপরীতে সারা দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। হক টাওয়ারের কর্ণধার ইমন উল হক তাঁদেরই একজন।