বন্ধ চিনিকল চালুর সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ, স্বদেশনির্ভর চিনিশিল্প গড়ার দাবি

বন্ধ চিনিকল চালুর সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে রংপুরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে টাস্কফোর্স কমিটি। রোববার বেলা ১১টার দিকে রংপুর নগরের একটি কমিউনিটি সেন্টারেছবি: মঈনুল ইসলাম

আওয়ামী লীগ সরকারের বন্ধ করে দেওয়া ছয়টি চিনিকল অন্তর্বর্তী সরকারের চালুর সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে বন্ধ চিনিকল চালুকরণ টাস্কফোর্স কমিটি। কমিটি বলছে, জাতীয় পর্যায়ে বন্ধ কারখানাগুলো খুলে দিতে এটি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। তবে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি নীতি কঠোর করতে হবে। বিদেশনির্ভর নয়, স্বদেশনির্ভর চিনিশিল্প গড়তে হবে।

বন্ধ চিনিকল চালুর সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে রংপুরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে টাস্কফোর্স কমিটি। আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় রংপুরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন টাস্কফোর্স কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল্লাহ ক্বাফী (রতন)। সংবাদ সম্মেলনে টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য মানস নন্দী, কামরুজ্জামান ফিরোজ ও আলতাফ হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

আবদুল্লাহ ক্বাফী বলেন, ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর করোনাকালে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার আখচাষি ও চিনিকল শ্রমিকদের কথা বিবেচনা না করে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর (গাইবান্ধা), শ্যামপুর (রংপুর), সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) ও পঞ্চগড় চিনিকল লোকসানের অজুহাত দিয়ে বন্ধ করে দেয়। জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার চিনিকলগুলো আবার চালু করার জন্য ও চিনিকলগুলো লাভজনকভাবে পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রণয়নে একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই টাস্কফোর্স মাড়াই স্থগিত হওয়া চিনিকলগুলো আবার চালুর সুপারিশ করে।

লোকসানের কারণ জানাল কমিটি

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারের হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৭০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে চিনিকলগুলো। সেই লোকসানের দায় শ্রমিক-কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কারখানা বন্ধের যুক্তি তৈরি করেছিল তৎকালীন সরকার। অথচ আখচাষিরা উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে অর্থাৎ লোকসানে চিনিকলগুলোকে আখ সরবরাহ করে। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে সংকটের একটা বড় কারণ চিনির উৎপাদন খরচ আমদানি করা চিনির বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। এই উৎপাদন ব্যয়ের একটা বড় অংশ আবার ঋণের সুদ। যেমন গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে ২০১৯-২০ মৌসুমে খরচ হয়েছিল ১৮৬ টাকা ২৪ পয়সা। এই চিনিকলের ১৫৮ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ ছিল। এর সুদ হিসাব করলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়িয়েছিল ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। পঞ্চগড় চিনিকলে একই মৌসুমে ব্যাংকের সুদসহ প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ছিল ৩০২, কুষ্টিয়ায় ২৭৩, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯ এবং পাবনায় ১৭৮ টাকা। আর সেই চিনি বিক্রি হয়েছে ৫৩ থেকে ৫৭ টাকা কেজি দরে।

টাস্কফোর্স কমিটি মনে করে, আখের অপর্যাপ্ত সরবরাহ, অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় একরপ্রতি আখের ফলন অনেক কম, পুরোনো প্রযুক্তি ও মেশিনের কারণে আখ থেকে চিনি আহরণ হার (রিকভারি রেট) অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় প্রায় অর্ধেক, পণ্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে উদ্যোগহীনতা, চিনি বিপণনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক হতে না পারা, আখ কেনা থেকে শুরু করে চিনি উৎপাদন ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতায় বেড়ে ওঠা পাহাড়সম ব্যাংকঋণ ও তার সুদ, অপ্রয়োজনীয় জনবলের বেতন–ভাতা ইত্যাদি কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর বড় প্রতিবন্ধকতা।

টাস্কফোর্স কমিটির সুপারিশ

টাস্কফোর্স কমিটি বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর বড় প্রতিবন্ধকতার পেছনে কৃষক-শ্রমিকদের দায়ী করার সুযোগ নেই। এ জন্য দায়ী সরকার ও প্রশাসনের ভুল নীতি ও দুর্নীতি। বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন ধরলে বর্তমান বাজারদরে বাংলাদেশে চিনির বাজার ৩২ হাজার কোটি টাকার। বর্তমানে পাঁচ থেকে ছয়টি বেসরকারি গ্রুপ রিফাইনারি কারখানা প্রতিষ্ঠা করে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধন করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে বাজারজাত করছে।

টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আখচাষিদের কাছ থেকে এক কেজি আখও কিনবে না। ফলে আখ চাষ শেষ হয়ে যাবে। পাঁচ লাখ চাষি নিঃস্ব হবেন। দেশের চিনি খাত হয়ে পড়বে বিদেশনির্ভর। আর তা নিয়ন্ত্রণ করবে মুষ্টিমেয় চিনি সিন্ডিকেট। দেশের ভোক্তারা আরও অসহায় হয়ে পড়বেন। দেশের চিনিশিল্পকে গড়ে তুলতে আমদানিনির্ভর নীতির পরিবর্তে চিনিকলগুলো সক্ষমতা তৈরি ও স্বদেশনির্ভর চিনিশিল্প গড়ার দাবি জানায় টাস্কফোর্স কমিটি।