হেলিকপ্টার দেখতে এসে লুটিয়ে পড়েন সুমাইয়া

আড়াই মাস আগে সন্তানের জন্ম দেন সুমাইয়া আক্তার। মায়ের জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে শিশুটি।

আড়াই মাসের মেয়ে রেখে মারা গেছেন সুমাইয়া আক্তার। নাতনিকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আসমা বেগম। গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহল্লায়ছবি: দিনার মাহমুদ

২০ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি এলাকায় বিক্ষোভকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। আকাশে টহল দিচ্ছিল র‍্যাবের হেলিকপ্টার। ওই হেলিকপ্টার দেখতে বারান্দায় এসেছিলেন আড়াই মাস আগে মা হওয়া গৃহবধূ সুমাইয়া আক্তার (২০)। এ সময় ‘গুলি’ মাথায় লেগে মুহূর্তেই বারান্দার মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

সুমাইয়ার মায়ের পরিবার সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি এলাকার একটি ভবনের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। সন্তান জন্মের জন্য সুমাইয়া মায়ের ভাড়া বাড়িতে এসেছিলেন। গত ১২ মে তিনি মেয়ে সোয়াইবাকে জন্ম দেন। আগামী শুক্রবার তাঁর স্বামীর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল।

গতকাল মঙ্গলবার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় আড়াই মাস বয়সী নাতনিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন সুমাইয়ার মা আসমা বেগম। তিনি বলেন, ‘ফুটফুটে নাতিনটা তার মাকে দেখতে পেল না। মায়ের আদরও পাইল না। বুঝ হওয়ার আগেই বুলেটের আঘাতে ওর মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। মায়ের ভালোবাসা ওকে কোত্থেকে দেব। মা ছাড়া সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। ওরে কীভাবে মানুষ করমু?’

আসমা বেগমের স্বামী সেলিম মাতবর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বামী নিরাপত্তাপ্রহরীর চাকরি করতেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার চর নন্দনপুর এলাকায়। স্বামীর মৃত্যুর পর তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে পাইনাদি নতুন মহল্লার এই বাড়িতে ওঠেন তিনি। দুই ছেলের একজন কার্টন কারখানায় ও অন্যজন পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তাঁদের আয়ে সংসার চলে।

সুমাইয়া আক্তার

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আসমা বেগম বলেন, ২০ জুলাই বিকেলে বাইরে গোলাগুলির শব্দ শুনে তিনি ফ্ল্যাটের উত্তর পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। শিশু মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হেলিকপ্টার দেখতে কিছুক্ষণ পর মেয়ে সুমাইয়া তাঁর পেছনে এসে দাঁড়ান। তখন আকাশে হেলিকপ্টার উড়ছিল। হঠাৎ সুমাইয়া মেঝেতে ঢলে পড়েন। মেয়ের মাথা থেকে রক্ত পড়তে দেখে চিৎকার করে ওঠেন। এ সময় রক্তে ঘরের মেঝে পুরো ভিজে যায়। মেয়েকে বাঁচাতে তিনিসহ দুই ছেলে পাগলের মতো হয়ে যান।

আসমা বেগম বলেন, মাথার ডান পাশে গুলিবিদ্ধ মেয়েকে ধরাধরি করে ছয়তলা থেকে নিচে নামান। সংঘর্ষের কারণে কোনো অটোরিকশা হাসপাতালে যেতে রাজি হচ্ছিল না। এলাকাবাসীর সহায়তায় অনেক কষ্টে একজনকে রাজি করিয়ে সাইনবোর্ডের প্রো অ্যাকটিভ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই মেয়ে মারা গেছেন। ওই দিন রাতেই মেয়েকে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকার কবরস্থানে দাফন করেন তাঁরা।

সুমাইয়ার স্বামী জাহিদ হোসেন কাঁচপুরে একটি পোশাক কারখানায় মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়। আড়াই মাস আগে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সুমাইয়া মায়ের বাড়িতে আসেন। মেয়েসহ শুক্রবার তাঁর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। শাশুড়ির মৃত্যুবার্ষিকীর কারণে ১৯ জুলাই তাঁর স্বামী জাহিদ কুমিল্লায় যান। এরপর কারফিউ ও গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় তিনি নারায়ণগঞ্জে ফিরতে পারেননি।

আক্ষেপ করে আসমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কেন বারান্দায় গেলাম? আমার দেখাদেখি মেয়ে বারান্দায় এসে গুলি খেয়ে মারা গেল। আমি না গেলে তো মেয়ে বারান্দায় যেত না। আমরা কার কাছে বিচার দেব? আল্লাহ হায়াত রাখেনি বলে মেয়েকে বাঁচেনি।’ একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সুমাইয়ার ছোট ভাই সজল বলেন, ওই দিন এলাকায় হেলিকপ্টার উড়ছিল। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি বারান্দার গ্রিলে লেগে বোনের মাথায় এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে বোন ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন। পুরো ঘরের ফ্লোর রক্তে ভেসে যায়।