উপকূল থেকে বিশ্বমঞ্চে জিমরান

জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯ , আজারবাইজান রাজধানী বাকুতে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন কক্সবাজারের জলবায়ু যোদ্ধা জিমরান মো. সায়েকছবি-সংগৃহিত

উপকূলের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম জিমরান মো. সায়েকের (২২)। ছোটবেলা থেকে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের  ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছেন বেশ কয়েকবার। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঘরবাড়ি। বেড়িবাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়া সমুদ্রের লোনাপানিতে ভেসে গেছে মাঠের ফসল, গাছপালা, গবাদিপশুসহ সম্পদ। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনের মুখে তখন শোনা যেত—এটি নেহাতই ভাগ্যের ব্যাপার।

তরুণ বয়সে এসে জিমরান বুঝতে পারেন, সেটি মোটেও ভাগ্যের ব্যাপার ছিল না, এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ ও শিল্পায়নের ফলে উপকূলীয় এলাকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়ছে, দুর্যোগ ক্রমেই কঠিনতর হচ্ছে অথচ তাঁদের পাশে তেমন কেউ নেই।

উপকূলের এই অসামঞ্জস্য জিমরানের চোখ খুলে দেয়। এমন অবস্থা থেকে উপকূলের মানুষকে রক্ষার তাগিদ জাগে তাঁর মনে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়তে হবে। আওয়াজ তোলা দরকার, নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে-জলবায়ু আন্দোলনে। নিজেরা না দাঁড়ালে কেউ তাঁদের পক্ষে লড়বে না।

কিন্তু এত কঠিন কাজ একার পক্ষে সামলানো সম্ভব? শৈশবে শেখা উক্তি মনে পড়ে যায় জিমরানের—ইচ্ছা থাকলে যে উপায় হয়।

২০১৭ সালে যাত্রা শুরু। উপকূলের গ্রাম-মহল্লায় গিয়ে নারী-পুরুষ তরুণ-যুবকদের নিয়ে শুরু করে উঠান বৈঠক, কর্মশালা । বোঝানোর চেষ্টা চালান—জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জানমালের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি।

উপকূলের মানুষের জন্য লড়তে লড়তে জিমরান হয়ে ওঠেন জলবায়ু-যোদ্ধা। উপকূলের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশ্বমঞ্চে।

জিমরানের বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী গ্রামে। বাবা নজরুল ইসলাম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মা আমিনা বেগম গৃহিণী। একমাত্র ছোট ভাই ইমরান মো. সায়েক শিক্ষার্থী।

জিমরান পড়াশোনা করেন কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে, পুরকৌশল বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারে। একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়তে একজন তরুণের অদম্য সংগ্রাম উপকূলীয় এলাকার মানুষের নজর কাড়ে, তাঁদের মনোবল সাহসী করে তুলছে।

৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামসেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে কক্সবাজার। জিমরানের জলবায়ু আন্দোলন উপকূলের মানুষজনকে সচেতন যেমন করেছে, তেমনি কক্সবাজারের অবস্থা বিশ্বমঞ্চে উঠে আসছে। জিমরানের ইচ্ছাশক্তির জোরে এটি সম্ভব হচ্ছে। জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় দেশের প্রতিটা জেলা-উপজেলাতে জিমরানের মতো অদম্যশক্তির আবির্ভাব দরকার।

ইয়ুথনেটে যাত্রা

২০১৬ সালে বরিশালের কীর্তনখোলাতে প্রথম যুব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কক্সবাজার উপকূলের প্রতিনিধি হিসেবে ওই সম্মেলনে যোগ দেন জিমরান। সেখানে গঠিত হয় জলবায়ু প্ল্যাটফর্ম ‘ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’ সংগঠন। নেতৃত্বে ছিলেন বরিশালের সন্তান সোহানুর রহমান। আট বছরের মাথায় ইয়ুথনেট হয়ে ওঠে দেশের সর্ববৃহৎ জলবায়ু আন্দোলনের সংগঠনে। কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী,  চট্টগ্রাম, চাঁদপুরসহ উপকূলীয় ১৯টি জেলায় ইয়ুথনেটের কমিটি রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ৪৫ জেলাতে এখন ইয়ুথনেটের কার্যক্রম চলছে, যার সদস্যসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।

কক্সবাজারে ইয়ুথনেটের যাত্রা ২০১৭ সালের মে মাসে। কমিটির প্রথম সমন্বয়ক ওমর ফারুক। বর্তমান কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন ফাহিম তাসনোহাদ। জিমরানও এই কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।

ইয়ুথনেটের পথচলা কেবল একটি সংগঠন নয়, এটি তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করা, পরিবেশ রক্ষা এবং একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার ঠিকানা। ইয়ুথনেটের স্লোগান হচ্ছে ‘নিরাপদ ধরিত্রী, সবুজ অরণ্য নিশ্চিত করবে দুর্জয় তারুণ্য’। জিমরান ইয়ুথনেটের কেন্দ্রীয় কমিটির যোগাযোগ সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন।

জিমরান প্রথম আলোকে বলেন, ইয়ুথনেটের মূল লক্ষ্য তরুণদের জলবায়ু ও পরিবেশবিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধি করা। বরিশাল যুব জলবায়ু সম্মেলনে সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়। তা তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তী সময়ে তৃণমূল পর্যায়ের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জলবায়ু অভিযোজন এবং পরিবেশ রক্ষার কাজকে ত্বরান্বিত করা হয়। ফলে ইয়ুথনেট এখন ১৫ হাজার প্রশিক্ষিত সদস্যের জলবায়ু আন্দোলনের বিশাল এক প্ল্যাটফর্ম। প্রশিক্ষিত তরুণেরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন।

কক্সবাজারে জলবায়ু যোদ্ধা জিমরান মো. সায়েক। জলবায়ু অভিঘাত নিয়ে কক্সবাজারের লোকজনকে সচেতন করেন অদম্য এই তরুণ
ছবি-সংগৃহীত

যেভাবে বিশ্বমঞ্চে

সম্প্রতি জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯ সম্পন্ন হয়েছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন জিমরান মো. সায়েক। যে সম্মেলন ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবিলার একটি বিশ্বমঞ্চ, যেখানে সারা বিশ্বের জলবায়ু কর্মী এবং বিশ্বনেতারা কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, অভিযোজন ও ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা করেন।

কপ২৯ সম্মেলনে জিমরান যোগ দেন গত ১৬ নভেম্বর। দেশে ফেরেন ২৩ নভেম্বর। দেশে ফিরে সম্মেলনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন কক্সবাজারের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা-সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে। কক্সবাজারের ট্যুরিস্ট পুলিশ, বেসরকারি সংগঠন ইয়াসিড, প্রত্যাশা, তারুণ্যের আভিযাত্রিক তার অন্যতম।

জিমরান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে উপকূলীয় এলাকার মানুষজন। এর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত ভাঙে উপকূল, ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন মানুষ, কমছে চাষাবাদের জমি। অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন মানুষ। বজ্রপাতে প্রাণহানিও বেড়েছে অনেক।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়া কিশোরী মেয়েদের স্বাস্থ্যগত সংকট, মেয়েদের শিক্ষার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাল্যবিবাহ, লিঙ্গবৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে খালবিল শুকিয়ে যাচ্ছে, তাতে জীবিকার উৎস ধ্বংস হচ্ছে। লবণাক্ততার আগ্রাসনে খাবার সংকটে গরু, ছাগল, মহিষ পালন কমে আসছে। পেশা হারিয়ে উপকূলের মানুষ শহরমুখী হচ্ছেন। কিন্তু এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় কারও জানা নেই কিংবা থাকে না।

কপ২৯ সম্মেলনের বিশ্বমঞ্চে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষজন এবং সম্পদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার বিবরণ তুলে ধরে জিমরান বলেন, গ্লোবাল ডায়ালগ ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সেশনে তিনি বাংলাদেশের যুব নেতৃত্বের ভূমিকা তুলে ধরেন। তা ছাড়া স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নে স্থানীয় ও বৈশ্বিক উদ্যোগের সমন্বয় নিয়ে আলোচনায় তিনি সেরা বক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান। জেন্ডার হাব সেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নারীদের ওপর প্রভাব, সমাধানের উপায় এবং লিঙ্গবৈষম্য ও সমতার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বক্তব্য দেন তিনি।

জিমরান বলেন, কপ২৯ সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের তরুণদের জলবায়ু কার্যক্রম তুলে ধরতে পেরেছেন। তাঁর বক্তব্য বৈশ্বিক তরুণদের অনুপ্রাণিত করে।

কপ২৯ সম্মেলন ছিল তাঁর কাছে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর সংকটের গল্প বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার বড় একটি সুযোগ।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

কপ২৯-এর পর জিমরান পরিকল্পনা করছেন কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় জলবায়ু সচেতনতার জন্য নতুন কর্মসূচি চালু করার। তখন আরও তরুণেরা সক্রিয়ভাবে জলবায়ু কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবেন। তাঁর স্বপ্ন কক্সবাজারকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, যেখানে মানুষ নিজেদের জীবিকা এবং পরিবেশ রক্ষায় নিজ উদ্যোগে কাজ করবে।

জিমরান বলেন, ‘আমি চাই কক্সবাজারের প্রত্যেক মানুষ এই সংকট সম্পর্কে সচেতন হোক এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাক। যদি আমরা সবাই মিলে কাজ করি, তাহলে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ সম্ভব।’