পাবনায় ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল, ‘বড় মন’ নিয়ে এগিয়ে এলেন গ্রামবাসী
নাজমা বেগমের (৩৫) মামাশ্বশুর মারা গেছেন। সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। রেললাইনের পাশেই নাজমার বাড়ি। ধীরে ধীরে তাঁর বাড়ির কাছে ট্রেনটি এসে থেমে গেল। কিছু সময় পার হলেও ট্রেনটি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। খোঁজ নিয়ে নাজমা জানতে পারলেন, ইঞ্জিন বিকল। ট্রেন কখন ছাড়বে, কেউ জানেন না। যাত্রীরা সকালের নাশতার জন্য ট্রেন থেকে নেমে দোকান-রেস্তোরাঁ খুঁজছেন, তবে আশপাশে কোনো দোকান বা রেস্তোরাঁ নেই।
এ রকম পরিস্থিতি দেখে এগিয়ে এলেন নাজমা বেগম। তিনি দ্রুত বাড়ির চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না শুরু করেন। পরে রেলের কর্মী ও কয়েকজন যাত্রী রেললাইনে বসে ওই খাবার খান। আশপাশের ৮ থেকে ১০টি পরিবার যাত্রীদের খাবার দিয়ে সহায়তা করে। এ ঘটনা গতকাল রোববার সকালের, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার তাঁতীবন্দ গ্রামের হুদারপাড়ায়।
ওই ট্রেনের টিটিই (ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার) ছিলেন আবদুল আলিম। আজ সোমবার দুপুরে আবদুল আলিম প্রথম আলোকে বলেন, ঢালার চর সেকশনের ট্রেনটি ঢালারচর থেকে ভোরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ট্রেনের কর্মচারী ও যাত্রীরা এ সময় সকালের নাশতা করে বের হওয়ার সুযোগ পান না। সাধারণত তাঁরা পাবনায় এসে নাশতা করেন। গতকাল পাবনার সাঁথিয়ার রাজাপুর ও তাঁতীবন্ধ স্টেশনের মাঝখানে এসে ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তখন ঘড়িতে সকাল ৮টা বেজে ৫ মিনিট। সবকিছু ঠিক হতে আরও তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ট্রেনের যাত্রীরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ওঠেছিলেন। তাঁদের জন্য নাজমা বেগম রান্না করেন।
আবদুল আলিম জানান, ট্রেনে রেলের কর্মচারী ছিলেন আটজন, যাত্রী ছিলেন প্রায় পৌনে তিন শ। তাঁদের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ জনকে খাবার দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অন্যদের জন্যও গ্রামবাসী খাবার রান্না করতে যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে ট্রেনের ইঞ্জিন সচল হয়ে যায়। পরে তাঁদের রান্না করতে নিষেধ করেন।
আজ দুপুরে মুঠোফোনে নাজমা বেগমের স্বামী হেলাল মোল্লার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, তিনি একজন দিনমজুর। ঘটনার সময় তাঁর মামাকে দাফন করতে গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রেনের যাত্রীদের বিপদ দেখে নাজমা যেতে পারেননি। বিপদে পড়া মানুষের জন্য তাঁর স্ত্রী যা করেছেন, তাতে তিনি খুশি।
আরও যাঁরা খাবার দিয়ে যাত্রীদের সহায়তা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুমি আক্তার (৩০)। তাঁর স্বামী বাবু খাঁ ভ্যানচালক। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। মুঠোফোনে সুমি আক্তার বলেন, ‘আমরা দৌড়পাড় কইরে ভাত, রুটি, খিচুড়ি, পানি আইনি খাওয়াইচি। অনেক মানুষ। যারা পাইনি। মুড়ি আইনি মুঠ মুঠ কইরি সবার হাতে দিয়ে এক গেলাস কইরি পানি দিচি। আমার স্বামী বাড়িত আইসি শুইনি সেই খুশি হইচে।’
ওই ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন টিটিই আবদুল আলিম। লিখেছেন, ‘... মানুষের জন্য কিছু করতে হলে আসলে বড় মন লাগে, যা তাঁতীবন্ধ এলাকার লোকজন আজ করে দেখালেন এবং এ সমস্ত সাধারণ মানুষই বাংলাদেশের সম্পদ। এ সম্পদ যদি এক থাকে, তবে এ দেশের অগ্রগতি কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব না। আজ ঢালারচর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল হওয়া থেকে সচল হওয়া পর্যন্ত সময়টুকুতে সে স্থানটিতে আমি যেন সহমর্মিতার এক অনন্য বাংলাদেশকে খুঁজে পেয়েছি, যেটা কখনোই পথ হারাবার নয়।’