‘পুরুষ দিনমজুরি পাওচে ৬০০ টাকা, আর হামাক দেয় ১৮০ টাকা’

কৃষি জমিতে আলু লাগাচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা। ২ ডিসেম্বর দুপুরে রংপুরের তারাগঞ্জের দোলাপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

পুরুষের সঙ্গে নারী শ্রমিকেরা মাঠে কাজ করেন। কিন্তু মজুরির বেলায় নারী শ্রমিকেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কাজ সমান করলেও নারীদের পারিশ্রমিক কম দেওয়া নিয়ে বহু বছর ধরেই অসন্তোষ রয়ে গেছে।

রংপুরের বিভিন্ন উপজেলায় এমন বৈষম্য দেখা যায়। মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকেরা এর প্রতিকার চেয়েছেন।

গত ৩০ নভেম্বর থেকে গতকাল ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আট দিনে রংপুরের বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচড়া, পীরগাছা ও রংপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন ফসলি মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, চলতি মৌসুমে আলু চাষের ধুম পড়েছে। মাঠে এই আলু লাগানোর কাজে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। এর কারণ হিসেবে জানা গেল, নারী শ্রমিকদের মজুরি কম, আলু কেটে জমিতে দ্রুত লাগানোয় পুরুষের চেয়ে পারদর্শিতা নারীদের বেশি।

নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, তাঁদের প্রত্যেককে দিনমজুরি হিসেবে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দিয়ে খাটানো হচ্ছে। অথচ একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছেন ৬০০ টাকা।

বেশ কয়েকজন আলুচাষি বলেন, জমিতে আলু লাগানোর কাজে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি পারদর্শী। আবার পুরুষের তিন ভাগের একভাগ মজুরির টাকায় নারী শ্রমিকদের পাওয়া যায়। নারীরা কাজে ফাঁকিও দেন না। এসব কারণে মাঠে আলু লাগাতে পুরুষের বদলে নারী শ্রমিকদের প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁরা। বর্তমানে দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরির নিচে একজন পুরুষ শ্রমিক মাঠে কাজ করেন না। অথচ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা মজুরিতে নারী শ্রমিকেরা একই কাজ করছেন।

৫ ডিসেম্বর দুপুরে পীরগঞ্জের কুমেদপুর এলাকার মাঠে ১১ জন নারী শ্রমিককে আলু লাগাতে দেখা যায়। সেখানে আলাপকালে নারী শ্রমিকদের দলনেতা হোসনেয়ারা বেগম বলেন, ‘জিনিসপাতির খুবে দাম। স্বামীর একার আয় দিয়া সংসার চলোচে না। ১৮০ টাকা করি দিন দেওচে। সাত দিন থাকি নাগাড়ে (টানা) আলু গাড়ার কাম করোচি।’

নারী শ্রমিক আয়েশা খাতুন বলেন, ‘বড় আলু কাটিয়া ভুঁইয়োত গাইড়বার নাগে। পুরুষ মানুষ একটা আলু কাটতে হামরা (নারীরা) পাঁচটা কাটি। ওমার (পুরুষের) চাইতে ভুঁইয়োত আলু গাইড়বারও (লাগাতে) পাই জোরে (দ্রুত)। তারপরেও পুরুষ দিনমজুরি পাওচে ৬০০ টাকা, আর হামাক দেয় ১৮০ টাকা। না করিয়াও উপায় নাই। মুই না কইরবার চাইলেও অনেকে করে। বাধ্য হয়া কম মজুরিতেই কাম করোচি।’

মাঠে মহিলা-পুরুষ সমান কাজ করি। কিন্তু হামাক দেয় ৬০০ টাকা দিন হাজিরা, মহিলাক দেয় ২০০ টাকা। কখনো মহিলারা হামার চাইতে বেশি কাজ করে। কারণ, কাজের সময় পুরুষেরা চা, পান, সিগারেট খাইতে দম নেয়। কিন্তু মহিলারা তা খায় না, টানা কাজ করে।
একাব্বর আলী, পুরুষ শ্রমিক

নারী শ্রমিকদের কাজে লাগিয়েছেন আলুচাষি ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘মহিলাদের আলু কাটাকাটির অভ্যাস আছে। এই কারণে পুরুষের চাইতে মহিলাদের আলু গাড়ার কাজ ফাবে বেশি (দ্রুত হয়)। আবার ১৮০ টাকা মজুরি দিলে মহিলা শ্রমিকের অভাব নাই। পুরুষ শ্রমিক নিলে দিন ৬০০ টাকা দেওয়ার নাগে। কাজ বেশি, টাকা কম—এই কারণে মহিলা শ্রমিক দিয়া আলু নাগাওচি।’ এ কথা বলেই একগাল হাসেন এই চাষি।

৬ ডিসেম্বর দুপুরে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী মাঠে আলু লাগাতে দেখা যায় ৯ নারী শ্রমিককে। এর মধ্যে একজন প্রামাণিকপাড়া গ্রামের শ্রমিক বুলবুলি বেগম বললেন, ‘রোইদোত পুড়ি সারা দিন কাম কাজ করিয়া হামরা পাই ২০০ টাকা, আর পুরুষ মজুরি পাওচে ৬০০ টাকা। হামরা মহিলা সেই জন্যে মজুরি কম।’ বুলবুলির কথা কেড়ে নিয়ে মমতা বেগম বলেন, ‘কামতো করি সমানে সমান। মজুরির বেলায় এত কম হইবে ক্যানে?’

আক্ষেপ করে মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ইউনূস সরকার আর ছাত্ররা নাকি সউক সমস্যার সমাধান করোচে। হামার মহিলা-পুরুষের মজুরি সমস্যার (বৈষম্যের) সমাধানটাও করুক।’

আলু খেতে কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। ২ ডিসেম্বর দুপুরে রংপুরের তারাগঞ্জের দোলাপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের মানব কল্যাণ সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জেমিন শেখ বলেন, মাঠে কাজ করা নারীরা কেউ স্বামীহারা, কারও স্বামী কাজ করতে অক্ষম, কিংবা কারও পরিবারে খাদ্যাভাব আছে। বাধ্য হয়ে অভাবের তাড়নায় তাঁরা মাঠে দিনমজুরির কাজ করেন। কিন্তু নারী শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। এই বৈষম্য দ্রুত দূর করা দরকার।

শ্রমিক একাব্বর আলী বলেন, ‘মাঠে মহিলা-পুরুষ সমান কাজ করি। কিন্তু হামাক দেয় ৬০০ টাকা দিন হাজিরা, মহিলাক দেয় ২০০ টাকা। কখনো মহিলারা হামার চাইতে বেশি কাজ করে। কারণ, কাজের সময় পুরুষেরা চা, পান, সিগারেট খাইতে দম নেয়। কিন্তু মহিলারা তা খায় না, টানা কাজ করে। হামরাও চাই পুরুষ-মহিলার মজুরি সমান হউক।’

তারাগঞ্জ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নুরেশ কাওসার জাহান বলেন, চাকরি-বাকরিসহ সরকারি কাজ যেমন টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজে নারী-পুরুষ সবাইকে সমান মজুরি দেওয়া হয়। সবার উচিত নারীদের পুরুষের সমান মজুরি দেওয়া।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে (রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা) ১ লাখ ১ হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৭ মেট্রিক টন। গতকাল শনিবার পর্যন্ত আলু রোপণ করা হয়েছে ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে।