সাতক্ষীরায় আহ্ছানিয়া মিশনে প্রতিদিন একসঙ্গে ৬ হাজার মানুষের ইফতারি

নলতা আহ্ছানিয়া মিশনের ইফতারিতে ডিম, ছোলা, চিড়া, ফিরনি, কলা, শিঙাড়া ও খেজুর দেওয়া হয়ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র রমজান মাসে প্রতিদিন একসঙ্গে এক-দুই হাজার নয়, একসঙ্গে ছয় হাজার মানুষের ইফতারির আয়োজন করা হয়। বছরের পর বছর ধরে চলছে এ আয়োজন। এই বিশাল আয়োজন করছে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন কর্তৃপক্ষ।

আহ্ছানিয়া মিশন কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৩৫ সালে খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (রহ.) নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আসার পর ১৯৪০-৪১ সাল থেকে তিনি প্রতিবছরই রমজানে এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন। প্রথম অবস্থায় স্বল্প পরিসরে কয়েকজনকে নিয়ে তিনি মিশন মসজিদে এ আয়োজন করতেন। পরে কলেবর বাড়তে থাকলে ইফতারির আয়োজন করতেন মিশন চত্বরে। তাঁর মৃত্যুর পরও এ আয়োজন অব্যাহত আছে। এখন এখানে একসঙ্গে ছয় হাজারের মতো মানুষ ইফতারি করেন। প্রতিনিয়তই এ সংখ্যা বাড়ে।

এ মিশনের মুখ্য হিসাবরক্ষক এবাদুল হক বলেন, শেডের নিচে বর্তমানে পাঁচ হাজার ব্যক্তির বসার ব্যবস্থা করা হয়। বাকি এক হাজার মানুষের ইফতারি আশপাশের বাড়িতে পাঠানো হয়। ইফতারিতে ডিম, ছোলা, চিড়া, ফিরনি, কলা, শিঙাড়া ও খেজুর দেওয়া হয়। এতে প্রতিদিন ব্যয় হয় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মিশনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা এই খরচের জোগান দেন। রোজার দেড় মাস আগ থেকে তাঁদের প্রস্তুতি শুরু হয়। ঝড়বৃষ্টিতে রোজাদারদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য প্রায় ছয় লাখ টাকা দিয়ে চলতি বছর অস্থায়ী শেড নির্মাণ করা হয়েছে। অস্থায়ী শেড প্রতি রমজান মাসে করা হয়ে থাকে।

এখানে দূরদূরান্ত থেকে রোজাদারেরা ইফতার করতে আসেন। তাঁরা এসে যাতে ভালোভাবে বসতে পারেন, ইফতারি করতে পারেন, আমরা সেই চেষ্টা করি।
মোমিনুর রহমান, স্বেচ্ছাসেবক

শনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, নলতা আহ্ছানিয়া মিশন বিশ্রামাগার চত্বরের পেছনে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। ২১ জনের একদল কর্মীর সমন্বয়ে কাজ চলছে। এ সময় সেখানে কাজ করতে থাকা জাকির হোসেন বলেন, ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হয় ইফতারি তৈরির আয়োজন। তাঁদের কেউ ছোলা, কেউ ফিরনি রান্নার কাজ করেন। আবার কেউ শিঙাড়া, ডিম সেদ্ধ ও চিড়া ভেজানোর কাজে ব্যস্ত হন। অনেকে কলা ও খেজুর পরিষ্কার ও বাছাইয়ের কাজ করছেন। কেউ বোতলে পানি ভরছেন। কেউ থালা-বাটি পরিষ্কার করছেন। ইফতারের পর আবার সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে রাত ১০টা বেজে যায়।

ভোর থেকে ইফতারি তৈরির মালামাল আসতে থাকে। প্রতিদিন বেলা আড়াইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত চলে ইফতারি তৈরির কাজ। বেলা দুইটার পর থেকে এক দল স্বেচ্ছাসেবক শুরু করেন বিশাল মাঠে ইফতার করার স্থান প্রস্তুতের কাজ।

অন্যান্য বছরের মতো ইফতারি তৈরির প্রধান বাবুর্চির দায়িত্ব পালন করছেন নলতা গ্রামের মো. মহব্বত আলী। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার মানুষের ইফতারি প্রস্তুত করছেন। তাঁর ৯ জনের দল ১৮০ কেজি ছোলা ভুনা, ৬ হাজার ডিম সেদ্ধ, পরিষ্কার করার পর ১৫৫ কেজি চিড়া ভেজানো ও ৬০০ কেজি দুধের ফিরনি তৈরি করে। ৩৮ বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তিনি এখানে ইফতারি তৈরির কাজ করছেন। তবে তাঁর দলের অন্যদের সম্মানী দেওয়া হয়।

শিঙাড়া তৈরি করেন ১২ জনের একটি দল। ওই দলের প্রধান নলতা মোবারকপুর গ্রামের মো. মোক্তার হোসেন। তিনি বলেন, ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে নলতা আহ্ছানিয়া মিশনে তিনি ইফতারি তৈরি কাজ করছেন। দেখতে দেখতে ৩৭ বছর পেরিয়ে গেল। আগে অল্প কয়েকজন সব কাজ করতেন। এখন কাজ সব ভাগ করা। বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর থেকে যখন মানুষ আসা শুরু করে, মনে হয় মিছিল আসছে। এত মানুষ দেখে মন জুড়িয়ে যায়।

স্বেচ্ছাসেবক দলের মাসুম বিল্লাহ বলেন, প্রতিদিন মাঠ প্রস্তুত, বসার ব্যবস্থা ও ইফতারি সরবরাহ করার জন্য চারটি দলে ৩০০ জনের স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেন। সবাই এসেছেন নিজ উদ্যোগে। কথায় কথায় স্বেচ্ছাসেবকদের একজন মোমিনুর রহমান বলেন, ‘এখানে দূরদূরান্ত থেকে রোজাদারেরা ইফতার করতে আসেন। তাঁরা এসে যাতে ভালোভাবে বসতে পারেন, ইফতারি করতে পারেন, আমরা সেই চেষ্টা করি।’

নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন কার্যকরী পরিষদের সদস্য আবুল ফজল বলেন, ছয়টা বাজতে না বাজতেই বিশাল শামিয়ানার নিচ পূর্ণ হয়ে যায়। কাতারে কাতারে বসা রোজাদারদের সামনে স্বেচ্ছাসেবকেরা পৌঁছে দিতে থাকেন ইফতারি। ওই সময় যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, তা ভ্রাতৃত্বের মিলনমেলা।

যশোর থেকে এখানে ইফতার করতে এসেছেন সাতজনের একটি দল। সেই দলের একজন মো. রকনুজ্জামান বলেন, ৮-১০ ধরে তাঁরা এখানে আসছেন। এত মানুষ মিলে ইফতার করার আনন্দ অন্য রকম।

নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, একসময় ১০ হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হতো। কিন্তু করোনা মহামারির পর এ সংখ্যা কিছুটা কমেছে।