এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত সাতক্ষীরার মানুষও, ‘মামলা আতঙ্কে’ তাঁরা
অনলাইন অ্যাপ এমটিএফইতে প্রথমে ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিড়ালাক্ষী মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক আক্তারুজ্জামান। ১৫ ডলার করে লাভ পেতে শুরু করার পর তিনি ঋণ করে সব মিলিয়ে আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। দুই সপ্তাহ আগে থেকে সেই অ্যাপ থেকে আর ডলার তুলতে পারছেন না আক্তারুজ্জামান।
রাতারাতি লাভবান হওয়ার আশায় আক্তারুজ্জামানের মতো সাতক্ষীরার অসংখ্য মানুষ এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার আশঙ্কায় ও ‘মামলার ভয়ে’ কেউ আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
এমটিএফই হচ্ছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামের একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (যেমন বিটকয়েন) ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। এখানে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলানো হতো। তবে ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এমটিএফই দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। গত শুক্রবার থেকে অ্যাপের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিপুল পরিমাণ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কেউ থানায় কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দপ্তরে অভিযোগ করেননি। সাতক্ষীরার দুজন বিনিয়োগকারী বলেন, গ্রাহকেরা অ্যাপ খোলার চেষ্টা করলে সামনে একটি বার্তা আসছে—‘আপনি যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, ব্যবসায় তার দ্বিগুণ টাকা লোকসান হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে লোকসান যাওয়া টাকা পরিশোধ না করলে কোম্পানি আইনে মামলা করা হবে।’ মামলার ভয়ে কোনো গ্রাহক টুঁ শব্দ করছেন না।
শ্যামনগর বিড়ালাক্ষী এলাকার গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে একটি টাকাও পাননি। বিড়ালাক্ষী গ্রামের আবদুল গণি থাকেন কুয়েতে। তিনি এ এলাকায় এসব অনলাইনের মাধ্যমে প্রতারণা করছেন। আবদুল গণির ভাই নওয়াবেঁকি কাদিরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার সহসুপার আবদুল রউফ ও অপর এক মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুল আহাদ প্রথমে এ এলাকায় মানুষকে অধিক লাভের আশা দেখিয়ে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নওয়াবেঁকি এলাকার রেজাউল করিম, রফিকুল ইসলাম ও উজ্জ্বল ২৫ হাজার টাকা করে; মো. মজনু ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, মোশারফ হোসেন ৮৫ হাজার টাকা, মো. হাবিবুল্লাহ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, আবদুল রশিদ ৭০ হাজার টাকাসহ কয়েক শত মানুষ ৮ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমটিএফইর বিদেশি এক প্রতিনিধি থাকেন। তিনি অনেকটা গোপনে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগ দেন। তাঁরা শিক্ষক ও ইমামদের মতো মানুষকে এটির প্রচারে ব্যবহার করেন। তাঁরা এলাকায় প্রচার করেন, এখানে বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন লভ্যাংশ পাওয়া যাবে। লোকসানের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তাঁদের কথামতো অনেক সাধারণ মানুষ এফটিএফই অ্যাপ ডাউনলোড করার পর অ্যাকাউন্ট তৈরির মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন। স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে টাকা দিলে ওই টাকার সমপরিমাণ ডলার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। আট হাজার টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত এভাবে বিনিয়োগ করা যায়। সাধারণত ২৫ হাজার টাকা জমা করলে ৫ ডলার, ৫০ হাজার বিনিয়োগে ১০ ডলার ও ৬০ হাজার করলে ১৫ ডলার লভ্যাংশ পাওয়া যায়। এসব লভ্যাংশের টাকা স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠানো যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাতক্ষীরা শহরের এক প্রকৌশলী জানান, অপর এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ধার নিয়ে তিনি ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন। একজন ব্যবসায়ী জানান, তিনি ব্যবসা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। এখন আর অ্যাপে ঢুকতে পারছেন না।
আবদুল গণির ভাই আবদুল রউফ বলেন, তিনি শুনেছেন অনেক মানুষ অনলাইনে ব্যবসা করতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাঁর ভাই আবদুল গণি ১৫ বছর ধরে কুয়েতে থাকেন। চার বছরের বেশি সময় বাড়িতে আসেন না। তিনি জড়িত কি না, তা তিনি জানেন না। তবে রউফ জড়িত নন। আবদুল গণির মামাতো ভাই আবদুল আহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বিষয় তাঁর জানা নেই। কেউ তাঁর কাছে অভিযোগ করেননি।
তবে সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম বলেন, কেউ অভিযোগ না করলেও বিষয়টি তাঁরা শোনার পর থেকে অনলাইন প্রতারক চক্রকে শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।