‘কী দোষ ছিল আমার মানিকের, গুলি খাইয়া মরতে হইলো’
দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজধানীর বনশ্রী এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন নাজমা বেগম (৪৫)। ছেলে নাজমুল হাসান (২১) পড়ালেখার পাশাপাশি ওই হাসপাতালে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। মা-ছেলের আয়ে চলত সংসার। ১৯ জুলাই আফতাবনগরের বাসা থেকে বনশ্রীতে হাসপাতালে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাজমুল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা এখন নির্বাক। বাসায় কেউ গেলেই হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছেন।
নিহত নাজমুল কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার চাপাতলি এলাকার সৈয়দ আবুল কায়েসের ছেলে। যদিও তিনি মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রামের মাতুব্বরবাড়িতে থাকতেন। নানাবাড়ি মাদারীপুরেই ছিল তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। কাজের সুবাদে মা-ছেলে রাজধানীর আফতাবনগরে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
মাদারীপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে খোয়াজপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রাম। গত শনিবার বিকেলে নাজমুলের নানাবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডের বড় একটি ঘরের বারান্দায় দেয়ালে পিঠ ঠুকে বসে আছেন নাজমুলের মা নাজমা বেগম। বাড়িতে সুনসান নীরবতা। উঠানে নাজমুলের খালাতো ভাই সুমন কাজী দাঁড়ানো। প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে তিনি বললেন, ‘আমার ভাই আট দিন ধরে কবরে শুয়ে আছে। বাড়ির পাশেই কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।’
নাজমুলের বড় বোন তানজিলা আক্তার (২৬) মাকে বারান্দা থেকে তুলে মেঝেতে থাকা সোফায় বসালেন। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। মেয়ে ও জামাতা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ছেলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা স্মরণ করে বিলাপ করতে থাকেন। বললেন, ‘আমি ক্যামনে এই যন্ত্রণা সহ্য করব। আমার তো একটাই মানিক আছিল। আমার এই সন্তান ছাড়া তো আর কেউ নাই। কষ্ট কইরা মানুষ করলাম, পড়াইলাম, লেখাইলাম, এখন কী পাইলাম। কী দোষ ছিল আমার মানিকের, গুলি খাইয়া মরতে হইলো। আমি ক্যামনে বাঁচমু, হায় আল্লাহ।’
নাজমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা-ছেলে একলগে কাম করতাম। বাবজান আমারে কইতো, “মা তোমার আর কষ্ট করতে হইবে না। আমি টাকা জমিয়ে বিদাশ জামু, আপু চাকরি করব, তোমার আর কষ্ট থাকব না।” এগুলো মনে পড়লে আমার বুকের মধ্যে যে ক্যামন করে তা কইতে পারতাছি না। সরকারের কাছে একটা জিনিস চাই, আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।’
নাজমুলের স্বজনেরা জানান, ঘটনার দিন ১৯ জুলাই দুপুরের খাবার খেয়ে নাজমুল আফতাবনগর থেকে বনশ্রী ফরাজি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। হাসপাতালে খণ্ডকালীন ফিজিওথেরাপিস্ট ছিলেন। কোটা আন্দোলন ঘিরে ওই দিন ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। নাজমুল সংঘর্ষ এড়াতে গুদারাঘাট এলাকা দিয়ে হেঁটে বনশ্রীর দিকে যাচ্ছিলেন। গুদারাঘাট সেতুতে ওঠার পর গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকজন বিক্ষোভকারী তাঁকে উদ্ধার করে গুদারাঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই দিন সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যায়। ওই দিন রাতেই তাঁর লাশ অ্যাম্বুলেন্সে নানাবাড়ি মাদারীপুরে আনা হয়। পরে জানাজা শেষে নানা আব্দুল রহমান মাতুব্বরের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
নাজমুলের বড় বোন তানজিলা আক্তার বলেন, ‘ভাই চাকরি করে আমাকেও লেখাপড়ার কাজে সহযোগিতা করতেন। ভাইডাকে যে এভাবে মরতে হইবে, এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। বুকের ভেতরটায় যে কী হচ্ছে, তা কাউকে বোঝাতে পারব না। আমাকে ভাইকে কেন গুলি করে মারা হলো, এটার বিচার আল্লাহ ছাড়া কার কাছে দেব?’
খালাতো ভাই সুমন কাজী বলেন, নাজমুল গত বছর ঢাকার ইমপিরিয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে স্নাতক করছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি হাসপাতালে খণ্ডকালীন কাজ করে ১২ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সহযোগিতা করতেন।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশীদ খান বলেন, ‘সহিংসতায় অনেকেই মারা গেছেন। তবে কোনো স্থানের তথ্য আমাদের কাছে আপাতত নেই। নিহতের পরিবার সহযোগিতার জন্য আমাদের কাছে আবেদন জানালে আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করব।’