পাবনায় ‘অভিভাবকহীন’ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরটি জিইয়ে রেখেছেন কেসমত আলী

এক কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মিত কমপ্লেক্সের উদ্বোধন ২০২০ সালের ১৯ আগষ্ট হলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। মাধপুর, পাবনা, ২৫ মার্চছবি: হাসান মাহমুদ

জনমানবের দেখা নেই। ময়লা–আবর্জনায় চারপাশ ঠাসা। ফোয়ারার জন্য তৈরি কৃত্রিম জলাশয়ে শেওলা জমেছে। কক্ষগুলো সব তালাবদ্ধ। ভেতরেও স্তূপ করে রাখা হয়েছে বইসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। আসবাবগুলো প্যাকেটবন্দী।

পাবনা জেলা সদরের দাপুনিয়া ইউনিয়নের মাধপুরে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর এভাবেই অনাদর–অবহেলায় পড়ে আছে। কেসমত আলী নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে এটির দেখভাল করছেন।

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় ২০২০ সালে জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। তবে গত পাঁচ বছরেও হস্তান্তর না করায় জাদুঘরটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।

নিজ উদ্যোগে কমপ্লেক্সের দেখাশোনা করেন পাশের বাসিন্দা কিসমত আলী। গতকাল পাবনা সদরের মাধপুরে
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় লোকজন ও এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ মাধপুর বটতলা এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এদিন যুদ্ধে একই স্থানে মোট ৯ জন শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্থানটি সংরক্ষণ ও সেখানে একটি স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়। এরপর ২০২০ সালে তৎকালীন সরকার সেখানে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ১ কোটি ৬৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ২০২০ সালের ১৯ আগস্ট জাদুঘর ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরের বছরের শেষ দিকে কিছু কাজ বাকি রেখেই ঠিকাদার নির্মাণের ইতি টানেন। এরপর সেখানে বেশ কিছু দামি আসবাব, বই ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি–সংবলিত ছবি আনা হয়। এর পর থেকেই জাদুঘরটি ওভাবেই পড়ে আছে।

পাবনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাহারুল ইসলাম বলেন, ‘জাদুঘরটি দেখেছি। জানামতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে এটি নির্মাণের টেন্ডার করেছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে পুরো কাজ শেষ হয়নি। এটি আমাদের কাছে হস্তান্তরও করা হয়নি। ফলে আমরা কোনো দায়িত্ব নিতে পারিনি। হস্তান্তর হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিন দেখা যায়, জাদুঘরের প্রধান ফটকে এক নারী গাছের পাতা কুড়াচ্ছেন। ভেতরে আর কোনো মানুষ নেই। মূল ফটক খোলা থাকায় খুব সহজেই প্রবেশ করা গেল সেখানে। ঢুকতেই পতাকা হাতে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। পেছনে টেরাকোটায় আঁকা ’৫২ থেকে ’৭১–এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পাশে দ্বিতল ভবনটিতে বেশ কিছু কক্ষ। তবে কক্ষগুলো সব তালাবদ্ধ। চারপাশ পুরোই অরক্ষিত।

কিছুক্ষণ পর জাদুঘরের সামনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। নাম  মো. কেসমত আলী। তিনি জানালেন, অরক্ষিত থাকায় তিনিই বর্তমানে নিজ দায়িত্বে জাদুঘরটির দেখভাল করছেন। কেসমত আলীর ভাষ্য, ঠিকাদার চলে যাওয়ার পর জাদুঘরটির চাবি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ছিল। তাঁরা মাঝেমধ্যে তালা খুলে সেখানে বসতেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাঁরা পালিয়ে যান। এরপর একদল লোক জাদুঘরটি ভাঙতে এসেছিল। পরে স্থানীয় লোকজনের বাধায় তাঁরা জাদুঘরের সামনে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি মুছে দিয়ে চলে যায়। পরে তিনি (কেসমত আলী) নিজ উদ্যোগে জাদুঘরটি দেখভালের দায়িত্ব নেন। জাদুঘরের চাবি সংগ্রহ করেন। পরে কক্ষগুলো খুলে ভেতরে প্রচুর আসবাব, বই ও মালামাল দেখতে পান। এর পর থেকে নিজেই রাতে পাহারা দিচ্ছেন। কয়েক মাস ধরে তিনিই জাদুঘরের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে সংযোগ ঠিক রেখেছেন।

কেসমত আলী প্রথম আলোকে বলেন, জাদুঘরটি তৈরির পর থেকে কোনো দিন কেউ এটা দেখতে আসেননি। কেউ খোঁজখবরও নেয় না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাই দেখভাল করতেন। তাঁরা এখন নেই। তাই বাড়ির সামনে বিধায় তিনি নিজে দেখভাল করছেন। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ২৯ মার্চ যুদ্ধ দিবস উপলক্ষে নিজ দায়িত্বেই এখানে একটি দোয়ার মাহফিল করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেসমত। হেকমত আলী নামের অপর একজন বলেন, ‘এত টেকা দিয়ে বিল্ডিং বানানো হলো, কিন্তু কেউ ইয়ের খোঁজও লেয় না, ইডার কারণই আমরা বুঝলেম না। তাই এখন নিজিরাই দেখভাল করতেছি।’

জানতে চাইলে দাপুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘জাদুঘরটি নির্মাণ হয়েছে দেখেছি। তবে এটির বিষয়ে কেউ কোনো দিন কিছু বলেননি। আমাদের কোনো দায়িত্বও দেয়নি। তাই আমরাও কোনো দিন খোঁজ নিইনি। বর্তমানে কারা দায়িত্বে আছেন, তা–ও জানি না।’