দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রকৃত রূপে ফিরতে শুরু করেছে কাউয়াদীঘি হাওর
এই আষাঢ়ে কাউয়াদীঘি হাওরজুড়ে ভাসান জল থই থই করার কথা। হাওরপাড়ের মাঠ, গ্রামীণ পথঘাট জলের নিচে ডুবে থাকার কথা। জেলেদের ছোট-বড় ডিঙিগুলো ছেঁড়াফাটা, রংবেরঙের পাল উড়িয়ে ভাসার কথা। অথচ এই বর্ষায়ও হাওরের প্রায় অর্ধেক শুকনো। দীর্ঘ খরায় বর্ষা মৌসুমের চেনা রূপ পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে হাওরটিকে। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ধীরে ধীরে প্রকৃত জলের চেহারায় ফিরছে কাউয়াদীঘি হাওর।
গত সোমবার বিকেলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের রসুলপুর, বিরইমাবাদ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাওরপারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাওরের পানি এখনো দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। তবে এই কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পানি কিছুটা বাড়তে থাকায় হাওর একটু একটু করে তার প্রকৃত জলের চেহারা ফিরে পেতে শুরু করেছে। দু-একটি ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে হাওরে নেমেছেন মৎস্যজীবীরা। কেউ জালের ফাঁদ পাতছেন। কেউ ফাঁদ তুলে মাছ ধরছেন। কিন্তু মাছের তেমন একটা দেখা মিলছে না। ফলে এবার জেলেদের মধ্যে মাছ ধরার আমেজও অনুপস্থিত।
হাওরপারের খোজারগাঁওয়ের মৎস্যজীবী রেজান আলীর জন্ম, বেড়ে ওঠা, জীবিকার সংগ্রাম—সবকিছুই হাওরকেন্দ্রিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা হাওর এত দিন হুকনাই (শুকনো) আছিল। অউ (এই) দুই-তিন দিনের বৃষ্টিতে হাওরে পানি অইছে। অন্য বছর বৈশাখ মাসেই পানি আইতো। পানি নাই, হাওরর মাছ আছেনি! আগর (আগের) মাছ নাই। আগে নয়া (নতুন) পানি অইছে। টেংরা, বাইম, গুলা (গুলশা), পাবিয়া (পাবদা) অভাব অইছে না। গুড়া (ছোট) মাছ আমরা আনছিই না। তুরা (অল্প) পানি অওয়ায় কিছু মাছ মিলের।’ রেজান আলী বলেন, হাওরে এত বেশি সময় ধরে পানি নেই, এমনটা তিনি আর কখনো দেখেননি।
মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, অন্য বছরগুলোয় এই সময় অনেক জাতের মাছ হাওরে এক-দুবার ডিম ছেড়ে দিত। পোনাগুলো বড় হয়ে উঠত। মাত্র বৃষ্টি হয়েছে। মাছ ডিম ছাড়লেও এ মাছ বড় হওয়ার তেমন সুযোগই পাবে না। এবার হাওরের মাছের অভাব অনেক বেশি হবে। এ ছাড়া অনেক জায়গা এখনো শুকনা। বৃষ্টি পেয়ে সবুজ ঘাস লকলক করছে। এসব জায়গায় এখন নৌকা, জলজ ঘাস, শাপলা-শালুক ভেসে বেড়ানোর কথা ছিল।
কাউয়াদীঘি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন এবং রাজনগর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। জেলার অন্যতম মিঠাপানির এই হাওরে বর্ষাকালে পানির স্তর ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত ওঠে। বৈশাখ মাসেই এই পানি বৃদ্ধি শুরু হয়।
খোজারগাঁও গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী কুতুব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য বছর এই সময় বাড়ির কাছে পানি থাকত। হাওরর ছোট মাছে বাজার ভরা থাকত। এবার অখনো হাওরর মাছই নাই। বর্ষা চলের। আর কোনো দিন পানি অইত, মাছ অইত। আমরার বাড়ি থাকি পানি অখনো (এখনো) দুই কিলোমিটার দূরই (দূরে)। যেখানে ঘরর কাছে পানি থাকার কথা।’
হাওরপারের মানুষ ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, গ্রামের মানুষের কাছে মাছ ধরাই প্রধান জীবিকা। অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে হাওরের ওপর নির্ভর করেন। আশ্বিন-কার্তিক পর্যন্ত হাওরে পানি থাকে। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ভাসান জলের পরিবর্তে হাওরের বুক শুকনোই ছিল এত দিন। এই আষাঢ় মাসে কয়েক দিনের বৃষ্টিতে হাওরের নিচু এলাকায় পানি জমছে। একটু একটু করে হাওরে পানি বাড়ছে। হাওর তার প্রকৃত চেহারায় ফিরছে।
কাউয়াদীঘি হাওর বিভিন্ন প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, পাখি এবং অন্যান্য বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। বিভিন্ন প্রজাতির মাছে সমৃদ্ধ একটি মিঠাপানির জলাভূমি এই হাওর। এ হাওরে উদ্ভিদের মধ্যে আছে শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানা, হিজল, করচ, তমাল, ভুঁইডুমুর, খাগড়া, বনগোলাপ, বরুণ, সিংড়াসহ ভেষজ নানা রকম জলজ উদ্ভিদ। মাছসহ জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যে আছে বড় খলিশা, নাপতানি, কই, মেনি, নাপিত কই, ছোট খলিশা, শোল, গজার, টাকি, কাইক্কা, লাল খলিশা, খোরশুলা, বাইলা, গোল চান্দা, লম্বা চান্দা, কাটা চান্দা, তারা বাইম, বড় বাইম, চিকরা বাইম, পুঁটি, জাটপুঁটি, কুঁচিয়া, কানপোনা, চেলা, চেবলি, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি।
স্থানীয় পাখির মধ্যে জলমোরগ, সাদা বক, পানকৌড়ি, কানিবক, শামুকখোল, পাতিকুট, ভুতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস ইত্যাদি। পরিযায়ী পাখির মধ্যে সরালি, গুটি ইগল, কুড়া ইগল, কাস্তে বক, কালেম, পানভুলানি, ধূসর বক, বড় বক ইত্যাদির দেখা মেলে এখানে। সরীসৃপের মধ্যে সাপ, কচ্ছপ, শিয়াল, মেছো বিড়াল ইত্যাদি প্রাণী আছে।
বিলম্বে পানি আসা হাওরের এই উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এলোমেলো হচ্ছে। এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত দেরিতে হওয়ায় হাওরে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি হয়নি। এর ফলে হাওরে দেশীয় মাছের প্রজনন ব্যাহতসহ অনেক জলজ উদ্ভিদ অস্তিত্বসংকটে পড়বে।’ হাওরের এই অচেনা চিত্র প্রাণপ্রকৃতির প্রতি মানুষের ধারাবাহিক অবহেলার ফসল বলে মনে করেন তিনি।