জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে ঈদের উৎসবকে যখন রোমন্থন করি, তখন স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যাই। ছোটবেলায় ঈদ ছিল এক অন্য রকম আনন্দের উৎসব। নতুন জামা বানাতে দরজির দোকানে মাপ দিতে যাওয়া, তারপর নতুন জামা হাতে পাওয়ার পর সেটি লুকিয়ে রাখা, যেন কেউ আগে দেখে না ফেলে! ঈদের দিন সইদের সঙ্গে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, ভাই–বোনদের সঙ্গে স্টুডিওতে ছবি তুলতে যাওয়া—এসব আনন্দের মুহূর্ত আজও হৃদয়ে জাগরূক। মনে হয়, সময় যেন আটকে গেছে, আমি এখনো সেই শৈশব–কৈশোরের রঙিন দিনগুলোর মধ্যেই আছি। কিন্তু যখন বাস্তবতায় ফিরি, তখন সবকিছু বিমূর্ত হয়ে যায়, ধূসর ও বিবর্ণ মনে হয়। মনের অজান্তেই চোখের কোণে জল এসে জমে।
আমাদের ছোটবেলার ঈদ আজকের মতো জৌলুশময় ছিল না। মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, ছিল পরিমিত জীবনের শিক্ষা। দাদা–দাদার ভাইদের বিশাল পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না হতো বড় বড় পাতিলে। ঈদের এক সপ্তাহ আগেই শুরু হতো প্রস্তুতি। পুরোনো শাড়ির পাড় জোড়া লাগিয়ে দরজা–জানালার পর্দা বানানো হতো, সোডা দিয়ে কাপড় ধোয়ার আয়োজন চলত। মুড়ি, চিড়া ও খই সংগ্রহ করে রাখা হতো ঈদের সকালে মলিদা তৈরির জন্য। ময়দার সঙ্গে রং মিশিয়ে কাঁঠালপাতায় গোলা লেপে শুকিয়ে বানানো হতো পিঠা। এত কাজ, এত পরিশ্রমের মধ্যেও ক্লান্তি ছিল না; বরং ঈদের প্রস্তুতিই ছিল এক অন্য রকম আনন্দ।
ঈদের দিন ভোরে সাবান দিয়ে গোসল করে নতুন ছাপা থান কাপড়ের ফ্রক পরার আনন্দ আজও মনে পড়ে। তারপর পরিবারের মুরব্বিদের সালাম করে বয়সভেদে চার আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত ঈদের সালামি পাওয়া ছিল আমাদের কাছে বিরাট প্রাপ্তি! ঈদের সকালের শুরু হতো মলিদা দিয়ে, এরপর গুড়ের পায়েস কিংবা গুড়ের সেমাই। দুপুরের খাবারে থাকত মুরগির মাংস আর আলুর ঝোল, যার স্বাদ আজও স্মৃতির পাতায় অমলিন।
তারুণ্যে পা রাখার পর ঈদের উৎসব বদলে গেল। বরিশালে পড়াশোনার সময় ঈদ পায় নতুন রূপ—সেমাই, ফিরনি, জর্দা, পোলাও–কোরমার ভিড়ে ঈদ যেন ভোজন উৎসবে পরিণত হলো। এরপর কর্মজীবন, বিয়ে ও সংসারের দায়িত্ব এসে ঈদের রং পাল্টে দিল। নারীদের জন্য ঈদ মানে তখন শুধুই স্বামী–সন্তান ও সংসারের তাগিদ।
আজকের ঈদ আর আমাদের শৈশবের ঈদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। একসময় ঈদ মানে ছিল সীমিত সম্পদের মধ্যেও অপরিসীম আনন্দ। এখন ঈদের বাহারি আয়োজন, নতুন কাপড়–গয়না, খাবারের জৌলুশ বেড়েছে; কিন্তু সেই আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! আগে একটা সাধারণ ফ্রকেই যে আনন্দ লুকিয়ে ছিল, এখন অসংখ্য পোশাকের মধ্যেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, নারীদের ঈদ শুরু হয় গভীর রাতে—ফিরনি, সেমাই, হালিম, জর্দা, চটপটিসহ বাহারি রান্নার আয়োজন করে। সকালে রান্নার কাজ শেষ হতেই দুপুরের ও রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিতে হয়। ফলে ঈদের দিনটাই কেটে যায় কাজে, নিজের জন্য কিছুই আর থাকে না।
সময়ের স্রোতে জীবন বহমান। কিন্তু কিছু অনুভূতি রয়ে যায় হৃদয়ের গভীরে অমলিন। আজ বুঝতে পারি, ঈদ আসলে শৈশব–কৈশোরের এক অমূল্য উৎসব, যা একবার হারালে আর ফিরে পাওয়া যায় না। এখনো যখন ঈদের কথা ভাবি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ফেলে আসা দিনগুলো—সখীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো সেই নির্ভার ঈদ, যেখানে কোনো দায়িত্ব ছিল না, ছিল শুধুই আনন্দ।
কিন্তু সময় কাউকে ছাড় দেয় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঈদের রং বদলে গেছে, সেই সোনালি আনন্দগুলো কোথায় যেন ফিকে হয়ে গেছে। ছোটবেলায় ঈদ মানে ছিল প্রাণের উচ্ছ্বাস, অবারিত স্বাধীনতা; আর এখন ঈদ মানে দায়িত্ব, ত্যাগ ও অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর প্রয়াস। হয়তো এটাই জীবনের ধরন—শৈশবের ঈদ পাওয়া যায়, কিন্তু ধরে রাখা যায় না।
তবুও ঈদের চাঁদ যখন আকাশে ওঠে, তখন মন কেমন করে ওঠে পুরোনো দিনের জন্য। সেই শৈশবের সাদামাটা ঈদ, সেই ফ্রকের উচ্ছ্বাস, চার আনা সালামির সুখ—সবকিছুই আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়। বড়দের ঈদ কি তবে শুধুই দায়িত্ব? নাকি এই দায়িত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অন্য রকম প্রশান্তি? হয়তো আনন্দ বদলে গেছে, রূপান্তরিত হয়েছে ভালোবাসায় ও আত্মত্যাগে। তবু কোথায় যেন মনে হয়, শৈশবের সেই ঈদের জন্য মন এখনো হাহাকার করে...।
লেখক: বরিশাল বিএম কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
(অনুলিখন করেছেন এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল)