পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতা সুরঞ্জিতের ভাঙচুর হওয়া বাড়ি পরিদর্শনে ইউএনও-ওসি
‘সবাই ভালো থাকবেন। আমি অনেক কষ্ট নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এসেছি জীবন বাঁচাতে। বিচার চাই আমার বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও পুকুর দখলের।’
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জিত সরকারের (৪৩) ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাস এটি। তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার ১৪ দিন পর তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভারতের কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকে ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেন।
সুরঞ্জিত সরকার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য। তিনি দুবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
আজ সোমবার দুপুরে মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়শা সিদ্দিকা, মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হরিদাস মণ্ডল ও মোহনপুরে দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা রায়ঘাটি ইউনিয়নের হাটরা গ্রামে সুরঞ্জিতের বাড়ি পরিদর্শনে যান।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট মোহনপুর থানায় অগ্নিসংযোগ, এসি ল্যান্ডের কার্যালয় ভাঙচুর, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, আওয়ামী লীগের কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেদিন বিকেলে হাটরা গ্রামে সুরঞ্জিত সরকারের বাড়িতে হামলা হয়। সুরঞ্জিত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বলেন, হামলাকারীরা বাড়িতে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাড়ে ৬ লাখ টাকা ও ১০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে। পরে ওই রাতে তিনটি গরুও লুট করে হামলাকারীরা। ঘটনার পর থেকে প্রতিদিনই সুরঞ্জিত ও তাঁর বড় ভাই সঞ্জিত সরকারের (৪৫) তিনটি পুকুরের মাছ লুট চলছে।
সুরঞ্জিতের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখার পরে গতকাল রোববার রাতে হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, চিকিৎসার জন্য আগে থেকেই তাঁর ভিসা করা ছিল। তিনি স্ত্রী ও ১২ বছর বয়সী একমাত্র ছেলেকে সঙ্গে করে ভারতে চলে এসেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর বাড়িতে এত বড় হামলা হলো, তারপর তিনি থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। মামলা রেকর্ড হয়নি। প্রশাসনের কোনো লোক তাঁর বাড়িতে যায়নি। প্রতিকার না পেয়ে ঘটনার ১৪ দিন পর গতকাল রোববার সকালে তিনি গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে এসেছেন।
সুরঞ্জিত বলেন, ৪ আগস্ট কোনো রাজনৈতিক নেতার বাড়িতে হামলা হয়নি। এই হামলা রাজনৈতিক কারণে হয়নি। অসুস্থতার কারণে তিন বছর থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে নেই। হামলাকারীদের চিনতে পেরেছিলেন কি না প্রশ্নে সুরঞ্জিত বলেন, তাঁদের মধ্যে ১৩ জনকে চিনতে পেরেছেন। তাঁরা কেউ ছাত্র নন।
হাটরা গ্রামে প্রায় ৭০টি হিন্দু পরিবার রয়েছে। আজ সোমবার দুপুরে সুরঞ্জিত সরকারের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য জিনিসপত্র আগুনে পোড়া। আগুনের শিখায় ওপরে আমগাছের পাতা-ডালাপালা পুড়ে গেছে। ভাঙা আসবাবপত্র এক জায়গায় পড়ে রয়েছে। সুরঞ্জিতের পুরো বাড়িই এখনো তছনছ করা অবস্থাতেই রয়েছে। ইউএনও ও ওসি ঘুরে ঘুরে সব দেখেন।
সুরঞ্জিতের অশীতিপর বাবা মন্টু চন্দ্র সরকার (৮৬) বলেন, ‘সেদিন বেলা তিনটার দিকে বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর করে আগুন দিয়ে টাকাপয়সা, সোনাদানা সব লুট করে নিয়ে গেল। আমি কৃষি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার জন্য ধান বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা গুছিয়ে রেখেছিলাম। বাক্সের তালা ভেঙে সেই টাকাটাও নিয়ে গেল। আমি অনুনয় করে বললাম, বাবারে, তোমরা যা পারো সব নিয়ে যাও, এই টাকা কয়টা নিয়ো না। তখন আমাকে এক বাড়ি (আঘাত) দিলে আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাই। ছেলের বউয়েরা মাথায় জল ঢেলে আমাকে সুস্থ করে। রাতে ভয়ে পাশের বাড়িতে ছিলাম। বাড়িতে ৬টি গরু ছিল। সকালে গিয়ে দেখি ৩টা গরু নিয়ে গেছে।’
সুরঞ্জিতের বড় ভাই সঞ্জিত সরকারের স্ত্রী লিপি সরকার (৩৪) বলেন, ‘সোনাদানা, টাকাপয়সা সব লুট করে বাড়ির জিনিসপত্রে আগুন দিল। এমন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল, মানুষ মানুষকে এভাবে বলতে পারে না। বাধা দিলে এক পর্যায়ে তারা আমার কোলের বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে আগুনে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন অন্য লোকজন ঠেকায়।’
সঞ্জিত সরকার বলেন, শুধু বাড়ি নয়, তাঁর ৬ বিঘার একটি, ছোট ভাই সুরঞ্জিতের একটি ৬ বিঘা ও একটি ২ বিঘা আয়তনের মোট তিনটি পুকুরের মাছ লুট করা হচ্ছে। রোববারেও মাছ লুট করা হয়েছে।
হাটরা গ্রামে ৪ আগস্ট বিকেলে দরিদ্র মিষ্টির দোকানি গোপাল চন্দ্র দাসের (৬৫) বাড়িতেও হামলা হয়। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তিনি গ্রামের হাটে মিষ্টি বিক্রি করেন। সরকার পতনের আনন্দ মিছিল যাওয়ার সময় তাঁর বাড়িতে ঢুকে পানি তোলার মোটর ভাঙচুর করে এক দল লোক। এ ছাড়া বাড়ির বেড়া ও জানালায় বাড়ি মারা হয়।
ইউএনও আয়শা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল, এসি ল্যান্ডের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার পরিবেশ ছিল না। ৪ তারিখের পর যেহেতু পুনরায় আর হামলা হয়নি, তাই ওনাকে আশ্বাস দেন, আর হামলা হবে না। ইউএনও হাটরা গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাইকে আশ্বাস দেন, আর সমস্যা হবে না।
ওসি হরিদাস মণ্ডল বলেন, এজাহারে একটু ভুল ছিল, সেই জন্য মামলা রেকর্ড করা যাচ্ছিল না। সুরঞ্জিতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আজকে তাঁর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছে। আজই মামলা রেকর্ড হয়ে যাবে। ১৩ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে মামলাটির বাদী হচ্ছেন তাঁর বাবা।