ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর দিকে এগোলে মালিগ্রাম বাজার। ওই বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে রশিবপুরা গ্রাম। গ্রামের মুন্সীবাড়ি পাড়ার ২০ থেকে ২৫টি বাড়ির শেষের দিকে ছিদ্দিক মুন্সীর বাড়ি। বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায়, অভাব লেগে আছে বাড়ির পরতে পরতে। ভিত পাকা টিনের চৌচালা দুটি ঘর। এই দুটি ঘরেই বসবাস করেন পরিবারের সদস্যরা।
গতকাল রোববার সকাল ১০টার দিকে এই বাড়িতে আগুন লাগার পর মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীকে জানানো হয়। দ্রুত আশপাশের লোকজন ছুটে এসে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেন। সামনে রান্নাঘরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকেই মনোযোগ ছিল সবার। সেই আগুন কিছুটা কমে এলে পাশের শৌচাগারের পাটকাঠির বেড়ায় জ্বলতে থাকা আগুন নেভাতে যান মানুষ। পাটকাঠির বেড়া সরাতেই দেখা যায় বাড়ির দুই শিশু অগ্নিদগ্ধ হয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।
তাদের দুজনকে উদ্ধার করে ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে মারা যায় ইসমাইল মুন্সী (৪)। এর আট ঘণ্টা পর দিবাগত রাত তিনটার দিকে মারা যায় ইয়াছিন মুন্সী (৩)। তারা সম্পর্কে চাচা–ভাতিজা।
ইসমাইল মুন্সী ভাঙ্গার ঘারুয়া ইউনিয়নের রশিবপুরা গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর ছিদ্দিক মুন্সী (৬২) ও নাসিমা বেগম (৩০) দম্পতির ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ইসমাইল। অপর দিকে ইয়াছিন মুন্সী (৩) ছিদ্দিক মুন্সীর ছেলে আসাদ মুন্সী (৩২) ও বিথি বেগম (২৮) দম্পতির ছেলে। এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সে ছোট। আসাদ মুন্সী গত বৃহস্পতিবার জীবনের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ধারদেনা করে সৌদি আরব গেছেন।
প্রতিবেশী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে তাদের জন্ম হলেও চাচা ইসমাইল মুন্সী ও ভাতিজা ইয়াছিন মুন্সীর মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। একজন ছাড়া অন্যজন চলতেই পারত না।
আজ সোমবার সকাল ১০টার দিকে রশিবপুরা দাখিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পাশাপাশি রাখা হয় দুই শিশুর কফিন। জানাজা হয় একসঙ্গে। এরপর মাদ্রাসা–সংলগ্ন কবরে পাশাপাশি চিরকালের জন্য শুইয়ে দেওয়া হয় ইসমাইল ও ইয়াছিনকে।
সন্তান ও নাতিকে হারিয়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন ছিদ্দিক মুন্সী। তিনি বলেন, গতকাল তিনি গ্রামের একটি বাড়িতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে যান। তাঁর স্ত্রী নাসিমা বেগম সকালের রান্না শেষ করে পাশের মালিগ্রাম বাজারে একটি এনজিওর কিস্তি দিতে যান। বাড়িতে ছোট ছেলে ও নাতিকে রেখে যান। এরই মধ্যে সব শেষ। তিনি বলেন, ‘আমার বড় ছেলে আসাদ মুন্সী (ইসমাইলের পিতা) ধারদেনা করে বৃহস্পতিবার সৌদি আরব যায়। তার ছেলেটাও মারা গেল। তাকে এখন কী বলে সান্ত্বনা দেব?’
প্রতিবেশী মজিবর মুন্সী (৬৪) বলেন, আগুন লাগার পরেই মসজিদের মাইক থেকে এলাকাবাসীকে জানানো হয়। এলাকার মানুষ আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। সবাই রান্নাঘরের আগুন নিভিয়ে বাড়ির অন্য ঘর রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। রান্নাঘরের পাশের শৌচাগারে দুই শিশু আটকা পড়ার বিষয়টি কারও ধারণায় ছিল না।
মজিবর মুন্সী আরও বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, শিশু দুটি হয়তো চুলায় পাটকাঠি দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। পরে আগুন ঘরে ধরে যাওয়ায় পাশের টয়লেটে আশ্রয় নিয়েছে। টয়লেটটির নিচে পাকা ও চারপাশে পাটকাঠির বেড়া ছিল।’
রশিবপুরা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. ইদ্রিস আলী বলেন, এ ঘটনায় পুরো এলাকাবাসী শোকাহত। দুজন ফুলের মতো কোমলমতি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু সহ্য করা যায় না।