‘হামার ছলডা দ্যাশের জন্যি শহীদ হলো, হামাকেরে খবরডা লিলো না কেউ’

আবদুর রহমান

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ওই দিন গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পোশাক কারখানার কর্মী আবদুর রহমান (২০)।

আবদুর রহমান বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর দুর্গম কাজলা ইউনিয়নের জামথল চরের বাসিন্দা ছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে থমকে গেছে পুরো পরিবার। চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে তারা।

আবদুর রহমানের বড় ভাই আল আমিন ঢাকা কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন তিনি। জামথল চরে তাঁদের জরাজীর্ণ বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে কথা হয় আল আমিনের সঙ্গে। ছোট ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, চার ভাইবোনের মধ্যে শৈশব থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন আবদুর রহমান। লেখাপড়া শেষে ভালো একটা চাকরি করে সংসারের হাল ধরার স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়। অভাবের তাড়নায় বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। দুর্গম চরাঞ্চলটিতে বসে না থেকে কাজের খোঁজে আট মাস আগে গাজীপুরে যান। সেখানে এসএস নিটওয়্যার নামের একটি পোশাক কারখানায় সুইং অপারেটর পদে কাজ নেন। প্রতি মাসে তাঁর পাঠানো টাকায় সংসার চলত; ছয় সদস্যের পরিবারের সবার খাবার জুটত।

প্রতি মাসের ৫ তারিখে বেতন পেতেন আবদুর রহমান। ৪ আগস্ট মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়েছে জানিয়ে আল আমিন বলেন, ‘রহমান বলেছিল, “কাল (৫ আগস্ট) বেতন পাব। পেলেই সংসার খরচের টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেব।” সেই টাকার জন্য ৫ আগস্ট বিকেলে তার মুঠোফোনে কল দিই। রাত আটটা পর্যন্ত ফোন বন্ধ ছিল। এত দীর্ঘ সময় কখনো ওর ফোন বন্ধ থাকে না। পরে এক আত্মীয়কে পাঠিয়ে রহমানের খোঁজ পাওয়া যায়। ওই দিন রাত ১১টার দিকে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় আল হেরা মেডিকেল সেন্টারে তাকে পাওয়া যায়। তবে ততক্ষণে সব শেষ। লাশঘরে রাখা আছে গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ। বুকে গুলির চিহ্ন।’

এক আত্মীয়কে পাঠিয়ে রহমানের খোঁজ পাওয়া যায়। ওই দিন রাত ১১টার দিকে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় আল হেরা মেডিকেল সেন্টারে তাকে পাওয়া যায়। তবে ততক্ষণে সব শেষ। লাশঘরে রাখা আছে গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ। বুকে গুলির চিহ্ন।
আল আমিন, আবদুর রহমানের ভাই

তরুণ ছেলেকে হারানোর শোক ভুলতে পারছেন না দিনমজুর বাবা মঞ্জু প্রামাণিক। আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘দ্যাশটা লতুন করে স্বাধীন হইল। হামার ছলডা দ্যাশের জন্যি শহীদ হলো। লতুন সরকার আসলো। হামাকেরে খবরডা লিলো না কেউ।’

কান্নার একপর্যায়ে আবদুর রহমানের মা সুফিয়া বেগম বলেন, ‘হাসিনা গদি ছেড়ে দ্যাশত থ্যাকে পালাল; লোকজন আনন্দ মিছিল করিচে। আর হামার বাড়িত চলিচে শোকের মাতম। রহমানের রোজগারে হামাকেরে মুখত ভাত জুটত। হামার বুকের ধনডাক ক্যান ওরা গুলি করে মারল? ক্যান ওরা হামাকেরে মুখের ভাত কাড়ে লিলো?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আবদুর রহমানের পরিবার খুবই হতদরিদ্র। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আজ মঙ্গলবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।

হাসিনা গদি ছেড়ে দ্যাশত থ্যাকে পালাল; লোকজন আনন্দ মিছিল করিচে। আর হামার বাড়িত চলিচে শোকের মাতম। রহমানের রোজগারে হামাকেরে মুখত ভাত জুটত। হামার বুকের ধনডাক ক্যান ওরা গুলি করে মারল?
আবদুর রহমানের মা সুফিয়া বেগম

যেভাবে প্রাণ গেল

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে রহমানের পরিবার জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৫ আগস্ট সকাল থেকেই ছাত্র-জনতা গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় অবস্থান নেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিজিবির দুটি গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। সেগুলোয় চেপে ৮০ জন বিজিবি সদস্য ময়মনসিংহের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা বিজিবির সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে মুহূর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা। দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলাকালে গুলিতে নিহত হন ছয়জন। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বিজিবির গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। বিজিবি সদস্যদের উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেলিকপ্টার আসে।

আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে আরেক দফা গুলি চালানো হয়। অন্যদিকে গুলিবিদ্ধ আবদুর রহমানকে মাওনা চৌরাস্তা আল হেরা মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।