সারা দিন কাজ করেও সংসার চলে না শারীরিক প্রতিবন্ধী গোপীর

লাঠি ভর করে দোকানে প্রবেশ করছেন গোপী বিশ্বাস। গত শুক্রবার বিকেলে নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া বাজারেছবি: প্রথম আলো

জেলা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া বাজার। বাজারের দক্ষিণ পাশে মুলিয়া-বাহিরগ্রাম সড়কের পাশে ছোট একটি একচালা দোকান। ওপরে টিনের চালা, চারপাশে নেই কোনো বেড়া। সেখানে বসে নষ্ট হওয়া ইলেকট্রিক মালামাল মেরামত করেন প্রতিবন্ধী এক যুবক। নাম তাঁর গোপী বিশ্বাস (৩২)। তাঁর বাড়ি বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কাজলা নদীর পশ্চিম তীরের পানতিতা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের নিতাই বিশ্বাস ও কল্পনা বিশ্বাস দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট।

জন্ম থেকেই একটি পা অচল গোপীর। চলাচল করতে হয় লাঠিতে ভর দিয়ে। জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধকতা সঙ্গী হলেও ছোটবেলা থেকেই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন তিনি। বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছেন নানা পেশায়। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্থায়ী হতে পারেননি কোথাও। সবশেষে ইলেকট্রনিক মালামাল মেরামতকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। তবে বর্তমানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ কাজে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না গোপীর। তাই পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাপন করছেন তিনি।

গত শুক্রবার বিকেলে গোপীর দোকানে বসে ঘণ্টাখানেক আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। এ সময় কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প বলেন তিনি। গোপী বলেন, ‘গরিব ঘরে জন্মাইছি। পড়াশোনা বেশি করতি পারিনি। যখন ক্লাস থ্রিতে পড়তাম, তহন থেকে স্কুলে পাশের এক দাদার দোকান থেকে টর্চলাইট, গ্যাস লাইটসহ বিভিন্ন জিনিস মেরামতের কাজ শিখতে থাকি। এর পর থেকে প্রায় ১৮ বছর ধরে এই মালামাল মেরামতের কাজ করি। মেরামতের কাজে আয় কম হওয়ায় মাঝে ভ্যান চালাইছি, চা বেচিছি। এমনকি ওয়েল্ডিংয়ের কাজও করিছি কিছুদিন। অনেকেই আমারে কাজে নিতে চাইত না। কারণ, অন্য সবার মতো তো আমি সব কাজ করতে পারি না।’

কেউ কাজে নিতে না চাইলেও জীবনযুদ্ধে থেমে থাকেননি জানিয়ে গোপী বলেন, ‘আমি বারবার চেষ্টা করিছি, যাতে কর্ম করে বাঁচতি পারি, কারও সাহায্য না নিতি হয়। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ওসব কাজে টিকতে পারিনি। এ কারণে ঘুরেফিরে আবার মেরামতের কাজে ফিরিছি। ১৫ বছরের মতো মুলিয়া বাজারে মাদুর পেতেই মেরামতের কাজ চালাইছি। গত তিন বছর হলো এই দোকানটায় বইছি। সারা দিন এখানে বসে টর্চলাইট, গ্যাস লাইট, এলইডি বাল্ব, স্প্রে মেশিন (কৃষিকাজে ব্যবহৃত), রাইস কুকারসহ বিভিন্ন জিনিস মেরামত করতেছি।’

দোকানে বসে লাইট মেরামত করছেন গোপী বিশ্বাস। গতকাল শুক্রবার বিকেলে নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যাকে নিয়ে চার সদস্যের সংসার গোপীর ঘাড়ে। দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে, সে এবার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। মেরামতের কাজ করে সামান্য আয় দিয়েই সব সামলাতে হয় গোপীকে। স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হয় উল্লেখ করে গোপী বলেন, ‘সারা দিন এখানে কাজ করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। কাজ ভালো পেলে সেদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হয়। মাঝেমধ্যে যন্ত্রপাতি ব্যাগে ভইরে এক পায়ে সাইকেল চালিয়ে পাশের তুলারামপুর হাটেও যাই কাজ করতে। কিন্তু বর্তমান বাজারে এ টাকায় সংসার চলে না। আজকে একটু হলুদ কিনি, কালকে একটু লবণ কিনি। ছোয়াল-মাইয়েরে একটু মাছ খাওয়াতি পারি না। দেনা হয়ে বাজার করি। তিন মাস পরপর প্রতিবন্ধী ভাতার অল্প কয়টা টাকা পাই, তা দিয়ে আবার কিছুটা দেনা শোধ করি।’

ছেলে-মেয়েকে কীভাবে মানুষ করবেন, তা নিয়েও নানা দুশ্চিন্তা গোপীর। কাঁদতে কাঁদতে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধী জীবনটাই অভিশপ্ত। পারি না তেমন কোনো কর্ম করতে। সংসার চালাব, নাকি ওদের মানুষ করব? আর্থিক এই অবস্থার মধ্য দিয়ে ছোয়াল-মাইয়ে মানুষ করার কোনো উপায় নেই। সরকারের কাছে কামনা করি, আমরা যেন ছোয়াল-মাইয়েরে মানুষ করতি পারি, সরকার সেইভাবে যেন আমাদের দিকে একটু তাকায়। সন্তানেরা যদি মানুষ হয়, তালি আমরা একটু আশা করতি পারব যে ওদের হাত ধরে সংসারটা চলবে। ওরা মানুষ হলে আমরা অসহায়ত্বের কষ্ট ভুলতি পারব।’

মুলিয়া, পানতিতা, কোড়গ্রাম, বনগ্রামসহ ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে গোপীর হাতের কাজের প্রশংসার কথা শোনা যায়। তাঁদের ভাষ্য, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও কারও কাছে হাত না পেতে কষ্ট করে আয় করে সংসার চালান গোপী। তাঁর কাজের মান ভালো। তিনি না থাকলে এসব মালামাল মেরামত করতে শহরে যেতে হতো। এতে অর্থ ও সময় ব্যয় হতো। তিনি থাকায় সবার উপকার হয়।

গোপীর দোকানের অপর পাশের একটি দোকানে দরজির কাজ করছিলেন রাজেশ কুমার মজুমদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘গোপী খুব ভালো কাজ করে। দীর্ঘদিন ধরে সে এ পেশায়। অনেক কষ্টে তার সংসার চলে। দেখে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু করার তো কিছুই নেই।’ সুজিত বিশ্বাস নামের আরেকজন বলেন, ‘গোপী খুব ভালো মানুষ। অনেক দিন ধরে এখানে কাজ করছে। আমাদের সব কাজ তাকে দিয়ে করাই। কারণ, সে কাজ ভালো করে।’