দিন কাটে পাতলা খিচুড়ি খেয়ে
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসার চরে বসবাস ছিল শুকুরুন বেগম (৩৫) ও সুরুতজামাল মিয়া (৪০) দম্পতির। ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে দুই বছর আগে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বতুয়াতলী চরে বাড়ি করেন। সুরুতজামাল পেশায় মৌসুমি জেলে। নিজের জমি নেই, বছর চুক্তিতে জোতদারের এক বিঘা জমি নিয়ে দুটি ঘর তুলেছিলেন। উজানের ঢলের কারণে সৃষ্টি বন্যায় এই দম্পতির ঘরে দফায় দফায় পানি উঠেছে। ১৫ দিন থেকে তাঁরা নৌকায় বসবাস করছেন। ঘরে খাবার নেই, দিনে একবেলা পাতলা খিচুড়ি খেয়ে দিন পার করছেন এই দম্পতি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন থেকে উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বতুয়াতলী চরের নদীপথে দূরত্ব দেড় ঘণ্টার পথ। সড়কপথে বতুয়াতলী যাওয়ার কোনো উপায় নেই। নেই কোনো নিয়মিত খেয়াঘাটের নৌকা। সেখানে যেতে হলে যাত্রাপুর নৌঘাটে গিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নিতে হয়।
গতকাল রোববার বিকেলে সরেজমিনে বতুয়াতলী চরে দেখা যায়, চারদিকে অথই পানি। মাঝখানে ছোট একটি চরে মাত্র অর্ধশত পরিবারের বসবাস। থই থই গলাপানিতে সারি সারি টিনের চালাঘর। পলিথিনের ছাউনি ঘরে এক শিশুর কান্নার শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে দেখা গেল, সেখানে কয়েকটি গরু ও ছাগল বেঁধে রাখা। একপলকে দেখে বোঝা যায়, এটি গোয়ালঘর। ঠিক তার পাশেই সুরুতজামালের স্ত্রী শুকুরুন বেগম চুলায় চাল-ডাল দিয়ে পাতলা খিচুড়ি বসিয়েছেন।
কোন সময়ের রান্না হচ্ছে, এমন প্রশ্নে শুকুরুন বেগম বলেন, ‘বন্যার পানিত চুলা ডুবি গেইছে। সকাল থেকে রান্না হয়নি। ত্রাণের নৌকা এসে গতকাল মুড়ি দিয়ে গেইছে। সকালে পানি দিয়ে ভিজানো মুড়ি খাইছি। এল্যা ছোট ছাওয়াডা (শিশুসন্তান) ভাত খাবার জন্য কান্না জুড়ি দিছে। ঘরত কোনো তরকারি নাই। শাকসবজির খেত বানের পানিত ডুবি গেইছে। খালি চাল-ডাল দিয়ে ঢলঢলা খিচুড়ি রান্না বসাইছি। এল্যা খিচুড়ি রান্না হলে খায়া রাত কাটামো।’
গতকাল থেকে ভারী বৃষ্টিপাত না হলেও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের ধরলা, তিস্তা নদী ও দুধকুমার নদের পানি বেড়েই চলেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতলে কিছুটা কমলেও এখনো তিনটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের ঢলে জেলার কালজানী, ধরনী, জিঞ্জিরাম, বারোমাসী, সংকোশ, গঙ্গাধরসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এসব নদীর পার ও চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের বসতবাড়িতে পানি উঠে রান্নার চুলা তলিয়ে গেছে। এতে শুকুরুন বেগমের বাড়িতে পানি উঠেছে। এখন তাঁর থাকার ঘরে গলাপানি।
বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী ছয়লাপ হয়া গেইছে। সারা দিন জাল ফেললেও নিজের খাওনের মাছ পড়ে না।
শুকুরুন বেগমের স্বামী সুরুতজামাল মিয়া বলেন, ‘দুই বছর আগে নদীভাঙনে বসতি হারানোর পর এখানে এসে বাড়ি করেছি। সবাই ড্রেজার দিয়ে মাটি কেটেছে। আমি গরিব মানুষ, ড্রেজার দিয়ে ভিটা উঁচু করবার পারি নাই। দুই মানুষে (স্বামী-স্ত্রী) হালকা একটু মাটি কেটেছিলাম। এখন বন্যার পানি এসে সেখানে গলাসমান পানি। আঙিনাত থাও পাওয়া যায় না। গরুর গোয়াল ঘরটা বেশি উঁচু করছিলাম। ১৫ দিন থাকি সেই গোয়ালঘরে একবেলা রান্না করি কোনোরকমে কষ্টে বাঁচি আছি।’
একই অবস্থা বতুয়াতলী চরের লাল মিয়ার (৪৫)। গত শনিবার লাল মিয়ার বাসায় রান্না চাল ছিল না। তাই সারা দিন কোনো রান্না হয়নি। শনিবার যাত্রাপুরের হাটবার। প্রতিবেশীর কাছে পাঁচ কেজি চাল কেনার টাকা দিয়ে লাল মিয়া সকালে তাঁর ডিঙিনৌকা নিয়ে বেরিয়েছিলেন মাছ ধরতে।
লাল মিয়া বলেন, ‘নিজের জায়গাজমি ব্রহ্মপুত্র নদে ভেঙে গেছে। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বাড়ি করে থাকি। নদীতে যা মাছ পাই, সেইটা বিক্রি করে পাঁচ সদস্যের সংসার চলে। বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী ছয়লাপ হয়া গেইছে। সারা দিন জাল ফেললেও নিজের খাওনের মাছ পড়ে না। জমানো যা টাকা ছিল, এই ১৫ দিনের বন্যায় সব শ্যাষ। এল্যা ত্রাণই ভরসা।’
গতকাল বিকেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তথ্যমতে, কুড়িগ্রামের প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে ধরলা নদীর পানি সদর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার, তালুক শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৫২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ৬৪ সেন্টিমিটার এবং হাতিয়া পয়েন্টে ৫৩ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা নদীর পানি বাড়লেও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এতে কুড়িগ্রামের তিস্তা, ধরলা নদী ও দুধকুমার নদের পানি সমতলে বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে ও ধরলা ও দুধকুমার অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে।