সংকট কাটিয়ে সুদিনের আশায় সমতলের চা-চাষিরা
উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার ১৩২ দশমিক ১৮ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা ঘিরে অপার সম্ভাবনা তৈরি হলেও চাষিরা কাঁচা চা-পাতার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছিলেন না। ফলে গত কয়েক বছরে দেখা দেয় নানা সংকট। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন ক্ষুদ্র চাষিরা। তবে সম্প্রতি পঞ্চগড়ে অনলাইনভিত্তিক নিলাম কেন্দ্র চালু এবং চা বোর্ড তৈরি ও চায়ের সর্বনিম্ন নিলামমূল্য প্রতি কেজি ১৬০ টাকা নির্ধারণ করায় কাঁচা চা-পাতার দাম কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। এতে সংকট কাটিয়ে আবারও সুদিনের আশা করছেন সমতলের চা-চাষিরা।
সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের পর সর্ব-উত্তরের পাঁচ জেলা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে সারা দেশে মোট ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার ৪৯৮ কেজি চা (মেড টি বা তৈরি চা) উৎপাদিত হয়। এই মৌসুমে উৎপাদনের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা (পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট)। এই মৌসুমে পাঁচ জেলার সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের মৌসুমের চেয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার কেজি বেশি। এই চা জাতীয় উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা চা-পাতা ২১ থেকে ২২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি সমতলের চায়ের আবারও সুদিন ফিরে আসবে।মতিয়ার রহমান, পঞ্চগড়ের সোনাপাতিয়ার চা–চাষি
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে সমতল ভূমিতে চা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। সে অনুযায়ী পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলামের চেষ্টায় স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হয়। প্রথম দিকে টবে, পরে পতিত জমিতে বাড়তে থাকে চা চাষ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চায়ের বাগান গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে এই চা চাষের পরিধি আশপাশের আরও চার জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলার পর ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের এই পাঁচ জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২০টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ২ হাজার ১৬৪টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ২০৭টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার ১৩২ দশমিক ১৮ একর জমিতে চা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের চা চাষের পরিধি ও উৎপাদন বিবেচনায় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে চায়ের তৃতীয় নিলামকেন্দ্র (অনলাইনভিত্তিক) চালু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৫৮টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা অনুমোদন নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় ২৭টি ও ঠাকুরগাঁও জেলায় একটি কারখানা চালু হয়েছে। এ ছাড়া এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু প্যাকেটজাতকরণ কারখানা। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
চা-চাষিরা জানান, উত্তরাঞ্চলে চা চাষ শুরুর পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাঁরা সুদিন দেখেছেন। তখন কারখানামালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে চা-চাষিরা কাঁচা চা-পাতা বিক্রি করে কেজিতে ৩৩-৩৯ টাকা পর্যন্ত দাম পেয়েছেন। কিন্তু এর পর থেকেই প্রতিবছর চায়ের দাম কমতে থাকে। গত মৌসুমে চাষিদের ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে কাঁচা চা-পাতা বিক্রি করতে হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ ওঠাতে না পারায় উত্তরের চা-চাষিদের বিপাকে পড়তে হয়। এমনকি অনেকে চা চাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। কেউ কেউ ক্ষোভে-দুঃখে চা-বাগান তুলে ফেলে অন্য কিছু করার চেষ্টা করেন। তবে এখন পঞ্চগড়ে অনলাইনভিত্তিক নিলামকেন্দ্র স্থাপন আর চা বোর্ডের সর্বনিম্ন নিলাম মূল বেঁধে দেওয়ার কারণে চায়ের সেই সুদিন আবারও ফিরবে বলে আশা করছেন চাষিরা।
পঞ্চগড় জেলার সোনাপাতিলা এলাকার চা-চাষি মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমার ৬০ একর চা-বাগান আছে। প্রায় চার বছর ধরে চা-পাতার দরপতনে আমরা চা-চাষিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে সম্প্রতি চা বোর্ড তৈরি ও চায়ের সর্বনিম্ন নিলামমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ায় কাঁচা চা-পাতার দাম কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা চা-পাতা ২১ থেকে ২২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি সমতলের চায়ের আবারও সুদিন ফিরে আসবে।’
চা-পাতা চাষে সুদিন ফেরাতে হলে গুণগত মানসম্পন্ন চা-পাতা উৎপাদনের জন্য তাগিদ দিলেন চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন। তিনি বলেন, তাঁরা চাষিদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে চা চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন। এতে দিন দিন উত্তরাঞ্চলে চা চষের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।