সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ঢুঁ মারেন শিহাব শাহরিয়ার। রক্তের প্রয়োজনে কারও বার্তা আছে কি না, জানতে দেখে নেন মেসেজবক্স, মিসড কলের তালিকাও। এরপর মেডিকেল কলেজে ক্লাস করতে যান। ক্লাস শেষে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচতলায় ‘সন্ধানী’তে গিয়ে বসেন। রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। রক্তের প্রয়োজনে আসা রোগীর স্বজনদের রক্ত জোগাড় করে দেন। মাঝেমধ্যে হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের খোঁজখবরও নেন।
শিহাব দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। রক্তদান সংগঠন সন্ধানীর দিনাজপুর ইউনিটের রোগী কল্যাণ সম্পাদক। পড়ালেখার পাশাপাশি রক্তদান কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। রোগীদের ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন শিহাব ও তাঁর সংগঠন সন্ধানী। এই কলেজে শিহাবের মতোই রক্তদান কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন সব্যসাচী বিশ্বাস। কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া সংগঠন মেডিসিন ক্লাবের সভাপতি তিনি।
আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালের নিচতলায় সন্ধানীর অফিসকক্ষে শিহাব ও সব্যসাচীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, সন্ধানী ও মেডিসিন ক্লাবের প্রত্যেক সদস্যের কাছে বিভিন্ন গ্রুপের রক্তদাতার সন্ধান আছে। রক্তের প্রয়োজনে তাঁদের কাছে কেউ এসে ফিরে গেছেন, এমনটি সাধারণত হয় না। রোগীর স্বজন থেকে চিকিৎসক—প্রায় সবাই শরণাপন্ন হন তাঁদের।
শিহাব বলেন, দিনাজপুরে রক্তদানের ক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বড় ভূমিকা রাখেন। এতে একদিকে যেমন রোগীর উপকার হয়, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেবার মানসিকতা আরও মজবুত হয়।
সংগঠনের রেজিস্ট্রার খাতা দেখে শিহাব জানালেন, যত দিন থেকে রেজিস্ট্রারে হিসাব রাখা হচ্ছে, সেই হিসাবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সন্ধানী থেকে ১৪ হাজার ৪৭৫ জনকে বিভিন্ন গ্রুপের রক্ত সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে দিনাজপুরে শুধু মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী এক হাজারের বেশির রক্তদাতার তথ্য আছে সন্ধানীর কাছে। এ ছাড়া মেডিকেলের ২১-৩২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদেরও ডেটা সংরক্ষিত আছে। কোনো কোনো রোগীকে, বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের একাধিকবার রক্ত সরবরাহ করা হয়েছে। মাসে ৪৫-৫০ ব্যাগ রক্তের সরবরাহ করে থাকে সন্ধানী। একইভাবে মেডিসিন ক্লাব সভাপতি সব্যসাচী জানান, মাসিক ৫০ ব্যাগের ওপর রক্তের চাহিদা থাকে। অনেক সময় চাহিদা অনুযায়ী রক্তের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়।
গত বছর থেকে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীর বাইরেও নতুন রক্তদাতার তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে সন্ধানী। এ ক্ষেত্রে একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করা হয়েছে। রক্তদানে আগ্রহীরা যে কেউ চাইলে সেখানে তাঁর তথ্য আপলোড করতে পারছেন। শিহাব জানান, দিনাজপুর শহরের বড় বড় হোটেল-রেস্টুরেন্টে তাঁরা কিউআর কোড সংবলিত একটি করে কার্ড রেখেছেন। আগ্রহীরা সেটি স্মার্ট ফোনে স্ক্যান করে সহজ উপায়ে ওয়েবসাইটে গিয়ে তথ্য সংরক্ষণ করছেন। সম্প্রতি ভালো সাড়াও পেয়েছেন তাঁরা।
দিনাজপুর মেডিসিন ক্লাব থেকে মেয়ের জন্য নিয়মিত রক্ত সহায়তা পান এক অভিভাবক। তাঁর মেয়ে তানহা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মুঠোফোনে ওই অভিভাবক বলেন, ‘৬ মাস বয়সে মেয়ের থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। প্রতি মাসে বি পজিটিভ গ্রুপের এক ব্যাগ করে রক্ত দিতে হয়। প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট হয়েছিল রক্ত জোগাড় করতে। পরে মেডিসিন ক্লাবের খোঁজ পাই। তিন বছরের বেশি সময় ধরে ওই ক্লাবের সদস্যরা নিয়ম করে মেয়ের জন্য রক্ত জোগাড় করে দিচ্ছেন।’
সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাবের মতো দিনাজপুরে বর্তমানে ডজনখানেকের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রক্তদান কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছে। এর মধ্যে রক্তদান সমাজকল্যাণ সংস্থা, বিরামপুর ব্লাড ব্যাংক, জাগরণ ব্লাড ফাউন্ডেশন, নীড ফর ব্লাড, ফুলবাড়ী ব্লাড ব্যাংক, বর্ণমালা ব্লাড ব্যাংক, লাল বিন্দু ফাউন্ডেশন, বাঁধন, প্রথম আলো বন্ধুসভা, জনশক্তি ব্লাড ব্যাংক, রক্তবন্ধু, তৈয়বা মজুমদার, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ব্লাড ডোনেশান সোসাইটি কাজ করছে। এ ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে অনেকেই রক্তদান করছেন।
৫৬ বার রক্ত দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে জাকারিয়া জাকিরের (৪৯)। তিনি বলেন, ‘যখন দেখি বা শুনি রক্তের প্রয়োজনে স্বজনেরা ছোটাছুটি করছেন, বিষয়টি খুব কষ্টদায়ক। তবে রক্তদানের ক্ষেত্রে এখনো কিছু কুসংস্কার আমাদের মধ্যে থেকেই গেছে। অনেকের মধ্যে ভীতি কাজ করে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।’
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন এ এইচ এম বোরহান উল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, সাধারণত থ্যালাসেমিয়া রোগী, প্রসূতি মা, দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণের কারণসহ জটিল কোনো অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রক্তের দরকার পড়ে। দিনাজপুরে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেবার মানসিকতা নিয়ে রক্তদান কার্যক্রম করে যাচ্ছে। এটা অনেক ভালো একটা বিষয়। তারা রক্তদাতাদের একটি তথ্যভান্ডার (ডেটাবেজ) তৈরির কাজ করছে। এতে রক্তের প্রয়োজনে রোগীদের ছোটাছুটির ভোগান্তি অনেকটা কমে যাবে।’