মাইন বিস্ফোরণে শহীদ পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিরক্ষায় জাদুঘরটি এখনো চালু হয়নি

মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ জাদুঘরটি এখনো চালু হয়নি। গত শনিবার সকালে দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

আজ ৬ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের এই দিনে দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায় মহারাজা গিরিজানাথ স্কুলে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিজয়ের ২১ দিনের মাথায় স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে পাঁচ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্য, বিজয় ছিনিয়ে আনার পর মাইন বিস্ফোরণে একসঙ্গে এত বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রাণহানির ঘটনা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে অজানা।

এ ঘটনায় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষায় মহারাজা গিরিজানাথ স্কুলসংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ জাদুঘর ও স্মৃতিমিনার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে নির্মাণের আড়াই বছরেও চালু হয়নি এর কার্যক্রম। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতিসৌধ জাদুঘর ও স্মৃতিস্তম্ভটি।

দিনাজপু‌রের লেখক আজহারুল আজাদের (জু‌য়ে‌ল) লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনাজপুর ট্র্যা‌জে‌ডি’ নামে বইয়ে বলা হয়েছে, সে‌দি‌ন মাইন বি‌স্ফোর‌ণের ঘটনায় অর্ধসহস্রা‌ধিক বীর মু‌ক্তি‌যোদ্ধা শহীদ হ‌য়ে‌ছেন। এ বিষয়ে লেখক আজহারুল আজাদ বলেন, মু‌ক্তিযু‌দ্ধের পর এত বীর মু‌ক্তি‌যোদ্ধার একস‌ঙ্গে প্রাণহা‌নি দে‌শের আর কোথাও ঘ‌টে‌নি। দিন‌টি‌কে জাতীয়ভা‌বে স্মরণ করাসহ পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত করার দা‌বি জানান তি‌নি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্রে জানা যায়, ৬ জানুয়ারির ওই ঘটনায় ২০২০ সালে গিরিজানাথ স্কুলসংলগ্ন শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে স্মৃতিসৌধ জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৬২ লাখ ৮ হাজার টাকা ব্যয়ে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সূচনা ট্রেডার্স ২০২২ সালে স্মৃতিসৌধ জাদুঘর নির্মাণকাজ শেষ করে এবং একই বছরে মহারাজা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। আর স্মৃতিমিনারটির প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ছিল বলে জানিয়েছে দিনাজপুর গণপূর্ত বিভাগ।

স্থানীয় কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, উত্তরের জেলা দিনাজপুর হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাতে। যুদ্ধ শেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আপন ঠিকানায় ফিরতে শুরু করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। শহরের বালুবাড়ি এলাকায় মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল ভবনে করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে জড়ো হতে থাকেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রসামগ্রী, মাইন, মর্টার শেল, গ্রেনেড, গোলাবারুদ সেখানে বাংকারে রাখা হয়। ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার কিছু সময় আগে হঠাৎ ট্রানজিট ক্যাম্পে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয় আকাশ। থমকে যায় শহরবাসী। ছুটতে শুরু করে যে যার মতো।

ওই ক্যাম্পে অবস্থানকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক, ফরহাদ আহমেদসহ কয়েকজন জানান, অস্ত্র, মাইন ও গোলাবারুদ ট্রাক থেকে বাংকারে নামিয়ে রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন অসাবধানতাবশত মাইন বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। সেই বিস্ফোরণ এতই শক্তিশালী ছিল যে স্কুলের আশপাশের বাড়িঘর ভেঙে পড়েছিল। স্কুলের সীমানাসহ আশপাশে পড়ে ছিল মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ। ভবনের ছাদ ধসে পড়েছিল মেঝের ওপর। এ ঘটনায় পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন।

অযত্নে পড়ে আছে শহীদ স্মৃতিমিনার। গত শনিবার সকালে দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, ঘটনাস্থলের মাটি সরে গিয়ে ২০-২৫ ফুট গভীর পুকুরে পরিণত হয়েছিল। ওই সময় ছয় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে শহীদ হয়েছেন পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ ও মাংস উদ্ধার করা হয়েছিল; যার ওজন হয়েছিল ৫০ মণের বেশি। পরদিন গোর-এ-শহীদ বড় মাঠে জানাজা শেষে শহরের পাশে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে সামরিক মর্যাদায় শহীদদের সমাহিত করা হয়। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় শহীদ ১২০ মুক্তিযোদ্ধার নামফলক স্কুলপ্রাঙ্গণে এবং ১৭৭ জনের নামফলক স্থাপন করা হয় চেহেলগাজী সমাধিস্থলে। এ ঘটনার পর ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরের কয়েকটি সংগঠন প্রথম শোকসভা করে। সেই বছর থেকে দিনাজপুরবাসী ৬ জানুয়ারি দিনটি মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস পালন করে আসছেন।

নির্মাণের আড়াই বছর পার হলেও চালু হয়নি স্মৃতিসৌধ জাদুঘরটি। সম্প্রতি জাদুঘরটি ঘুরে দেখা যায়, ভবনের প্রধান ফটকে ঝুলছে তালা। চারপাশে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। স্মৃতি সংরক্ষণের নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো জনবলও নিয়োগ করা হয়নি।

মহারাজা গিরিজানাথ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাসউদ আলম বলেন, ‘কয়েকটি টেবিল, চেয়ার, র‌্যাক, আলমিরা, কিছু বই ও ছবি আমাকে দেওয়া হয়েছে। কোনো জনবল সেখানে নেই। তাই কিছু আসবাব বিদ্যালয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।’ দ্রুত জনবল নিয়োগ দিয়ে জাদুঘর চালু করার দাবিও জানান তিনি।

দিনাজপুর মহারাজা স্কুল মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক বলেন, ‘আমরা কিছুই জানি না। কে উদ্যোগ নিল, কারা করল, কাকে বুঝিয়ে দিল, এসবের কিছুই জানি না। প্রতিবছর সেখানে মিনারে ফুল দিয়ে আসি। এমন ঘটনা বাংলাদেশে আর একটিও নেই। এ বিষয়ে স্মৃতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’