নরসুন্দা নদীবক্ষে পাথরের ব্যবসা, ভরাট হচ্ছে তলদেশ
তারঘাট বাজারসংলগ্ন নরসুন্দা নদীবক্ষে পাথরমহালে ১০ কোটি টাকার বেশি পাথর বেচাকেনা হয়। কিন্তু এটি সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়নি।
নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে পাথর বেচাকেনার মহাল। এতে তলদেশ ভরাট হয়ে নদী মরার উপক্রম হয়েছে। পাশাপাশি সেই পাথরমহালে বসানো হয়েছে প্রচণ্ড শব্দ উদ্গিরণকারী পাথর ভাঙার ক্র্যাশার মেশিন। এসব মেশিন চলার সময় পাথরের মিহি গুঁড়া বাতাসে উড়তে থাকে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে চারপাশের বায়ুদূষণ। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলছে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মুশুলি ইউনিয়নের তারঘাট বাজার–সংলগ্ন নরসুন্দা নদীতে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর পাথরমহালে ১০ কোটি টাকার বেশি পাথর বেচাকেনা হয়। কিন্তু সরকারের কোনো সংস্থার সংশ্লিষ্টতা নেই এখানে। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। নান্দাইল উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, তারঘাট বাজারের পাথরমহাল সরকারি ইজারা ডাকা হয় না। স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের ফাঁকফোকরে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি তারঘাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের ওপর দিয়ে চলে গেছে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক। পাশ দিয়েই বয়ে গেছে নরসুন্দা নদী। নদীর ওপর রয়েছে সেতু। সড়ক ও নৌ যোগাযোগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা সেখানে গড়ে তুলেছেন কোটি টাকার পাথর বেচাকেনার মহাল। ময়মনসিংহ ও আশপাশের জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি বেসরকারি নির্মাণ প্রকল্পে এখান থেকে পাথর সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন কোয়ারি থেকে নৌপথে আমদানি করা হয় বড় বড় পাথর। বিপুল পরিমাণ পাথর বাল্কহেডে করে তারঘাট বাজারে এনে নরসুন্দা নদীবক্ষে নামিয়ে রাখা হয়। পরে পাথরগুলো নদীর তীর বা ওপরে স্থাপন করা ক্র্যাশার মেশিনে ভাঙিয়ে ক্রেতাদের চাহিদামতো আকারে (সাইজ) বিক্রি করা হয়।
নদীবক্ষে পাথর রাখার কারণে বর্ষাকালে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলার কারণে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নদীর প্রশস্ততাও হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া বড় পাথর ভেঙে ছোট করার জন্য মহালের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে অননুমোদিত ক্র্যাশার মেশিন। এসব মেশিন দিয়ে পাথর ভাঙানোর সময় পাথরের গুঁড়া বাতাসে ওড়ে। এসব মিহি গুঁড়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে পাথরমহালে নিয়োজিত শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতির কথা বললেও ব্যবসায়ীদের প্রভাবের কারণে তাঁরা তাঁদের নাম–পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।
নদীবক্ষে পাথর রাখার কারণে বর্ষাকালে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলার কারণে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নদীর প্রশস্ততাও হ্রাস পেয়েছে।
এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে তারঘাট বাজারের পাথর মহাল এলাকা এবং এর আশপাশের বায়ুর মান পরিমাপ করা হয়নি। তবে খালি চোখে দেখা যায়, ক্র্যাশার মেশিন থেকে পাথরের মিহি গুঁড়া উড়ে গিয়ে বাতাসে ধোঁয়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ক্র্যাশার মেশিন পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। নান্দাইল উপজেলার তারঘাট বাজারের পাথরমহালে কতগুলো ক্র্যাশার মেশিন চলছে, সেই তথ্য তাঁর জানা নেই। এসব মেশিন চালানোর জন্য তাঁর দপ্তর থেকে কেউ ছাড়পত্র নেয়নি।
বিষয়টি নজরে আনা হলে নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরুণ কৃষ্ণ পাল জানান, সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এসে তারঘাট বাজার পরিদর্শন করে গেছেন। তবে ওই সময় কোনো ব্যবসায়ীকে পাওয়া যায়নি। ইউএনও আরও জানান, নিয়মনীতি না মেনে ওই বাজারে পাথর ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে আইন প্রয়োগ করতে গেলে শ্রমিকদের সামনে ঠেলে দিয়ে ব্যবসায়ীরা অন্তরালে চলে যান। ফলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। নদীদূষণ ও দখলের বিষয়টি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে জানানো হবে।
নিয়মনীতি না মেনে ওই বাজারে পাথর ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে আইন প্রয়োগ করতে গেলে শ্রমিকদের সামনে ঠেলে দিয়ে ব্যবসায়ীরা অন্তরালে চলে যান। ফলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।অরুণ কৃষ্ণ পাল, ইউএনও, নান্দাইল
তবে তারঘাট পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আয়ুব আলী খানের দাবি, সেখানকার ব্যবসায়ীরা রাজস্ব প্রদান করেই পাথরের ব্যবসা করছেন। তাই এখানে উপজেলা পরিষদ থেকে ইজারা ডাকের প্রথা প্রচলনের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি দাবি করেন, নরসুন্দা নদীর জায়গায় নয়, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ও ভাড়া করা জায়গায় পাথর রাখেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া ক্র্যাশার মেশিন চালিয়ে দূষণ তৈরি করার অভিযোগের মুঠোফোনে প্রথম আলোকে আয়ুব আলী বলেন, ‘চারপাশে টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে মেশিনগুলো চালানো হয়। পানি ছিটানো হয়। তাতে করে মানবদেহের বা পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা নদী দূষণ করছেন না। নরসুন্দা একটি মরা নদী। বছরে মাত্র চার-পাঁচ মাস পানির প্রবাহ থাকে। মরা নদীর আবার দূষণ কিসের।’