‘চোখের সামনে মানুষটারে মাইরা ফালাইল, চাইরটা সন্তানের কী হইব’
স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে প্রাইভেট কারে ঢাকা থেকে গাজীপুরের শ্রীপুরে যাচ্ছিলেন ওষুধ ব্যবসায়ী হাসিবুল ইসলাম ওরফে বাদশা (৪০)। যানজটের কারণে শ্রীপুরে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছাতে তাঁদের রাত তিনটা বেজে যায়। তখন হাসিবুলের স্ত্রীকে ঘিরে ধরে ১৫ থেকে ২০ জনের কিশোর-তরুণদের একটি দল। একপর্যায়ে তারা স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে হাসিবুল বাধা দেন। তখন স্ত্রী-সন্তানদের সামনে হাসিবুলকে ইট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে তারা। স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রী মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘চাইরটা সন্তানের এখন কী হইব? চোখের সামনে মানুষটারে এইভাবে মাইরা ফালাইল।’
গতকাল বুধবার দিবাগত রাতে শ্রীপুরের কেওয়া পশ্চিমখণ্ড মসজিদ মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত হাসিবুল বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ইলোহার গ্রামের বাসিন্দা। তবে শ্রীপুরে শ্বশুর মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে থাকতেন। সেখানে তাঁর একটি ওষুধের দোকান আছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে নিহত হাসিবুলের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনদের ভিড়। বাড়ির ভেতর কান্নার আওয়াজ। আহাজারি করছেন নিহত হাসিবুলের শাশুড়ি হনুফা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমাদের পরিবারে সেই আছিল একমাত্র ভরসার মানুষ। বাড়িঘর দেইখা রাখা, স্ত্রী-সন্তান ও আমারে দেইখা রাখার আর কেউ রইল না। যারা আমার মেয়ের জামাইরে মারছে, আমি তাদের ফাঁসি দেইখা মরতে চাই।’
হনুফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকারীরা স্থানীয়। তাঁরা তাঁদের সবাইরে চেনেন। জায়গাজমি কিংবা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কারও বিরোধ ছিল না। মাদকাসক্ত তরুণ ও কিশোরদের কয়েকটি গ্রুপ নিয়মিত এলাকায় টহল দেয়। স্থানীয় রুবেল দলের নেতৃত্বে দেন। তাঁরা এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ মাদক বিক্রি ও সেবন করেন। তাঁদেরই কয়েকজন মিলে প্রথমে স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করেন। বাধা দেওয়ায় হাসিবুলকে ইট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন।
নিহত হাসিবুলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার বলেন, তাঁরা রাতের খাবার খেয়ে ঢাকা থেকে শ্রীপুরে আসেন। আজ সন্তানদের স্কুলে ভর্তির কাজ করার কথা ছিল। যানজট থাকায় বাড়িতে পৌঁছাতে রাত পৌনে তিনটা বেজে যায়। বাড়ির সামনে পৌঁছালে স্থানীয় রুবেল, রোমান, অন্তরসহ ১৫ থেকে ২০ জন তাঁকে ঘিরে ধরেন। একপর্যায়ে স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের সঙ্গে ঘরের চাবি ছিল না। দোকান থেকে স্বামী ওই চাবি নিয়ে ফিরে দেখেন, তাঁর স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিচ্ছেন এবং মারধর করছেন। তখন তিনি বাধা দিলে তাঁরা তাঁকে ইটের আঘাত করে হত্যা করেন।
ছিনতাই, চাঁদাবাজি এলাকার নিয়মিত ঘটনা
ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকায় বিগত দুই-তিন বছর ধরে উন্মুক্তভাবে মাদক কেনাবেচা হয়। শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের বেতন দেওয়া শুরু হলে রাতে নিয়মিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। মনিরুল ইসলাম নামের এক কারখানা শ্রমিক বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর রাতে তিনি কারখানা থেকে বের হয়ে সড়ক ধরে বাসায় যাচ্ছিলেন। পথে মসজিদ মোড় এলাকায় কিশোর বয়সী সাত-আটজন তাঁর পথরোধ করে দাঁড়ান। জোর করে তাঁর কাছ থেকে স্মার্টফোন কেড়ে নেন।
স্থানীয় ভাড়াটে এক কারখানা শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতি মাসে ৬ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন কারখানায় বেতন দেওয়া শুরু হয়। তখন ওই সড়কে ১২ থেকে ২৫ বছর বয়সী কিশোর-তরুণদের দৌরাত্ম্য দেখা যায়। গত মাসের ৯ তারিখ রাত একটায় তাঁর এক স্বজনের কাছ থেকে জোর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ওই কিশোর-তরুণেরা।
কেওয়া পশ্চিমখণ্ড মসজিদ সড়কের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন ইসলাম উদ্দিন। আজ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে কান্নার আওয়াজ পেয়ে মসজিদ মোড় থেকে সামান্য উত্তরে গিয়ে দেখেন, হাসিবুল মাটিতে পড়ে আছেন। অন্যরা কান্নাকাটি করছেন। পরে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, মাসখানেক আগে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী ২০ থেকে ৩০ জন রড ও অস্ত্র হাতে সড়কে তাণ্ডব চালান। তাঁরা সবাই উচ্চ শব্দে মোটরসাইকেলে চলাচল করেন। বন্ধ থাকা বিভিন্ন দোকানে অহেতুক ভাঙচুর চালান। এরপর চলে যান। ওই কিশোর-তরুণেরা বিভিন্ন সময় উন্মুক্তভাবে সড়কে মাদকসেবন করেন। তাঁদের কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পান না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় মো. আলী আকবরের ছেলে অন্তর (২০) ও পাশের ময়মনসিংহ জেলার পাগলা থানা এলাকার নিজামের ছেলে মো. রোমানকে (২১) অভিযান চালিয়ে পুলিশ আটক করেছে। তাঁদের দুজনের একজনের বাড়ি নিহত ব্যক্তির শ্বশুরবাড়ির ২০০ গজের মধ্যে।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, এ ঘটনায় নিহত হাসিবুলের স্ত্রী বাদী হয়ে থানায় তিনজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। দুজন ইতিমধ্যে পুলিশের হেফাজতে আছে। অন্য আসামি রুবেলকে তাঁরা আইনের আওতায় আনতে অভিযান চালাচ্ছেন।