রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নকশা অনুমোদন করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নে স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে কারা অধিদপ্তরে নকশা পাঠানো হয়েছে। নকশায় থাকছে না কারা অভ্যন্তরের দোমহলা ভবন, দৃষ্টিনন্দন ফটক ও কবর সেল। তবে নকশায় ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড রাখা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে এখনো কেউ বলতে পারছেন না।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮৪ সালে প্রথম রাজশাহী কারাগার নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৯১৪ সালে সেটিকে কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। কারাগারের মোট জমির পরিমাণ ৫৪ দশমিক ৯৬ একর। কারাগারের অভ্যন্তরে জমির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৯৬ একর। বন্দীর ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৪৬০ জন।
ঐতিহাসিক স্থাপনা খাপড়া ওয়ার্ডে নিম্নমানের খাবার ও বন্দীদের নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন ও আন্দোলন করায় ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল দেশপ্রেমিক রাজবন্দীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায় তৎকালীন পুলিশ। এতে সাতজন বন্দী নিহত হন। এই মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কমিউনিস্টদের ভূমি নিয়ে ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০’ নামে বই লিখেছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
কারাগারে ‘দোমহলা’ নামে একটি দ্বিতল ভবন আছে। নান্দনিক এ ভবনের বাইরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা আছে। লাল রঙের ভবনটিতে সর্বশেষ কবে বন্দী রাখা হয়েছে, কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। কারাগারের কবর সেল নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। কবর সেলে বন্দীদের রেখে ভেতরে জোঁক ছেড়ে দেওয়া হতো। দেখতে ঠিক কবরের মতো। অর্ধেকটা মাটির নিচে। ওপরের অংশে ভেন্টিলেশনের জন্য তিনটি বাঁকানো নল আছে। সেখানেও সর্বশেষ কবে বন্দী রাখা হয়েছে, কেউ বলতে পারেন না।
কারাগারের ঐতিহাসিক স্থাপনা খাপড়া ওয়ার্ড। নিম্নমানের খাবার ও বন্দীদের নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন ও আন্দোলন করায় ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল এই খাপড়া ওয়ার্ডে দেশপ্রেমিক রাজবন্দীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায় তৎকালীন পুলিশ। এতে সাতজন বন্দী নিহত হন। আহত হন ৩২ জন।
নিহত রাজবন্দীদের মধ্যে ময়মনসিংহের সুখেন্দু ভট্টাচার্য, দিনাজপুরের বলরাম সিংহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুধীন ধর, কুষ্টিয়ার দেলোয়ার হোসেন ও হানিফ শেখ, খুলনার বিজন সেন ও আনোয়ার হোসেন ছিলেন। তাঁরা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী। এই মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কমিউনিস্টদের ভূমি নিয়ে ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০’ নামে বই লিখেছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
খাপড়া ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাশে নির্মিত শহীদ মিনারের গায়ে নিহত রাজবন্দীদের নাম খোদাই করা আছে। প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কারাগারের নতুন নকশায় খাপড়া ওয়ার্ড থাকলেও নেই শহীদ মিনার। এ বিষয়ে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাপড়া ওয়ার্ড কম্পাউন্ড হবে। সেখানে শহীদ মিনার থাকতেও পারে।’
রাজশাহী গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন নকশাটি স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি কারা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। নকশায় ৬৪টি নতুন স্থাপনা স্থান পেয়েছে। একমাত্র পুরোনো ভবন হিসেবে খাপড়া ওয়ার্ডটি রাখা হয়েছে। পুরোনো ভবন হিসেবে নকশায় এটির কোনো নম্বর পড়েনি। নতুন কারাগারের ধারণক্ষমতা হবে দুই হাজার জনের। এর মধ্যে নারীদের ওয়ার্ডে মায়েদের সঙ্গে বাচ্চাদের দিবাযত্ন কেন্দ্র ও বিনোদনের জন্য ফিমেল জেল স্কুলও থাকছে। প্রায় ৫০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের নাম ‘রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণ প্রকল্প।’
রাজশাহী কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তৎকালীন পূর্ব বাংলার দুটি প্রেসিডেন্সি কারাগারের মধ্যে একটি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার। অন্যটি ঢাকায়। প্রায় ২৫০ বছর পুরোনো। কারাগারের ভেতরের অবকাঠামোগুলো সেই সময়কার। এর মধ্যে দোমহলা, হাসপাতালের একটি ভবন, দু-একটি ব্যারাক ব্যবহারের অনুপযোগী। কারাগারে কাগজে–কলমে ধারণক্ষমতা এক হাজার চার শতাধিক হলেও নানা কারণে এখন ৮০০-৯০০ হয়ে গেছে। তবে এখন বন্দী আছেন দুই হাজার সাত শতাধিক।
কামাল হোসেন আরও বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের রাস্তাঘাট ও নালা উঁচু করায় কারাগারের ভূমি প্রায় ২ ফুট নিচে পড়ে গেছে। কারাগারের ভেতরের ময়লা-আবর্জনা বাইরে যাচ্ছে না। একটু বৃষ্টি হলেই ভেতরে চরম দুরবস্থা তৈরি হয়। নতুন কারাগারের নকশা অনুমোদন করে কারা অধিদপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সরকার দ্রুত নির্মাণকাজ শুরু করবে। সর্বোচ্চ মানের নিরাপত্তাব্যবস্থায় একটি দৃষ্টিনন্দন প্রতিষ্ঠান হবে। যতগুলো কারাগার পুনর্নির্মাণ করা হবে, তার মধ্যে এটি মডেল কারাগার হবে। খাপড়া ওয়ার্ডের ব্যাপারে বলেন, ‘এটি সংস্কার করা হবে। নকশায় এটি আছে।’
কানাডাপ্রবাসী স্থপতি রাজিউদ্দীন আহমাদ সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণের কথা শুনে তিনি বলেন, এই কারাগারের প্রধান ফটকের প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য আছে। সারা পৃথিবীতে এমন স্থাপনা ব্যবহার উপযোগী না হলেও সংরক্ষণ করা হয়। প্রধান ফটকটি ব্যবহার উপযোগী না হলেও সংস্কার করে নতুন নকশার সঙ্গে সমন্বয় করা উচিত। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সেই সময় দোমহলা (দোতলা) ভবন নির্মাণ করা সহজ ছিল না। হয়তো কোনো দুর্ধর্ষ বন্দী অথবা ভিআইপিদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি ব্যবহার উপযোগী না হলেও প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যের কারণে সংরক্ষণ করা উচিত।