‘এই ধনু খুবই রাক্ষুইস্যা, আমার সবকিছু গিইল্লা খাইছে’
ধনু নদে সহায়-সম্বলের প্রায় সবই হারিয়েছেন নুরুজ্জামান মিয়া ও নুরেছা। একসময় ঘরবাড়ি, জমিজমা, গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত প্রাণী—সব ছিল তাঁদের। কিন্তু বর্তমানে নিঃস্ব এই দম্পতি চার সন্তান নিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছেন হাওরের পাশে অন্যের একটুকরা জমিতে। সেখানে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে ছোট দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন। ঘরটিতে বসে নুরুজ্জামান বেশ আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন, ‘এই ধনু খুবই রাক্ষুইস্যা। আমার সবকিছু গিইল্লা খাইছে। অহনও শান্ত হইছে না।’
নুরুজ্জামানের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুর ইউনিয়নের মান্দারবাড়ি গ্রামে। তাঁর মতো শত শত পরিবার ধনু নদের ভাঙনে এখন গৃহহীন ও নিঃস্ব হয়েছে। মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরি উপজেলার অন্তত সাতটি গ্রামে ধনু নদের ভয়াবহ ভাঙন চলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
গ্রামগুলো হলো মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুর, গাগলাজুর বাজার, মান্দারবাড়ি, চানপুর এবং খালিয়াজুরি উপজেলার পাতরা, ফরিদপুর শিবির, চরপাড়া ও রসুলপুর গ্রাম।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, প্রায় তিন দশক ধরে নদের ভাঙনে এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, গ্রাম রক্ষা বাঁধ ও সড়ক বিলীন হয়েছে। নদের ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে ওই গ্রামগুলোতে নদের ভাঙন অব্যাহত আছে। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা ধনু নদের ভাঙন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
পাউবো নেত্রকোনা কার্যালয় ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, ধনু নদের ভাঙনের কবলে পড়ে গত ৩০ বছরে গ্রামগুলোর সহস্রাধিক পরিবারের বাড়িঘর, চার হাজার একর ফসলি জমি ধনু নদের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ সময়ে গাগলাজুর বাজারের প্রায় শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন অব্যাহত থাকায় হুমকির মুখে আছে এসব গ্রামের অন্তত কয়েক হাজার বাসিন্দা।
গত বৃহস্পতিবার দেখা যায়, মান্দারবাড়ি ও পাতরা এলাকায় নদতীরের মানুষ ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। গাছগুলোও কেটে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ নদের তীরে বাঁশ ও গাছের সাময়িক বাঁধ দিয়ে বসতবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করছেন। এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী নুরজ্জামান মিয়া বলেন, ‘নদের ভাঙনে আমি নিঃস্ব। এ পর্যন্ত ৯ বার স্থান পরিবর্তন করছি। রাক্ষুইস্যা নদ আমার সোনার সংসার ধ্বংস কইরা দিছে। অহন আমার কিছুই নাই। পরিবার লইয়া বন্দের মাঝখানে এই উঁচা জায়গায় ছাপরা ঘর বানাইয়া থাকতাছি।’
মান্দারবাড়িসংলগ্ন খালিয়াজুরির পাতরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীর সরকার ঘরের কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এহন বাড়িটা যেখানে বেঁধেছি, সেখানে একটা খেত ছিল। নদটি এখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছিল। গত ১০ বছরে ভাঙতে ভাঙতে এখন বাড়িতে এসে ঠেকেছে। এ সময়ের মধ্যে সাতবার বাড়ি বানানো হয়েছে।’
ধনু নদের ভাঙনে বিলীন হওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে পাতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দ্রুত স্থায়ী বাঁধ না দিলে দুই এক বছরের মধ্যে এটি নদের গর্ভে চলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক কাঞ্চন সরকার। ওই বিদ্যালয়সংলগ্ন একটি বাড়ির মালিক জানান, নদ থেকে রাতের বেলায় বড় বড় নৌকা নিয়ে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। এতে ভাঙন আরও বাড়ছে। বাধা দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি আরও জানান, ১৯৯৫ সাল থেকে নদের ভাঙন চলছে। এই দীর্ঘ সময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বর্ষা এলেই পাউবোর কর্মকর্তারা ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে মাপজোখ করে চলে যান। মাঝেমধ্যে কিছু জিও ব্যাগ সেখানে ফেলা হয়। কিন্তু স্থায়ী বাঁধের কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। আর্থিক অসংগতির কারণে অনেকে এই ঝুঁকির মধ্যে ঘরবাড়ি সরাতে পারছেন না।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন। ভাঙনরোধে একটি প্রকল্প তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হবে শিগগিরই।নেত্রকোনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাওয়ার জাহান
নদটির ভাঙনের কারণে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় গাগলাজুর বাজারের ব্যবসায়ীরা। কাজল মিয়া নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, নদে বাজারের অনেক দোকানপাট ভেঙেছে। বাজারটি এখন হুমকির মুখে। ব্যবসায়ীরা কয়েক বছর ধরে পাউবো, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ঘুরছেন। কিন্তু স্থায়ী কোনো বাঁধের ব্যবস্থা হয়নি।
অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তাঁদের দাবি, বিভিন্ন সময়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এ বিষয়ে গাগলাজুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য ও মান্দাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা মিনারা আক্তার বলেন, ভাঙনে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক পরিবার ভিটাছাড়া। হাজার হাজার একর জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাওয়ার জাহান জানান, তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন। ভাঙনরোধে একটি প্রকল্প তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হবে শিগগিরই।