বাঘ পরিচিতির কারণে বিপন্ন হচ্ছে মেছো বিড়াল

জলে-স্থলে তুখোড় শিকারি মেছো বিড়াল আকারে গৃহপালিত বিড়ালের চেয়ে কিছুটা বড়। ‘মেছো বাঘ’ পরিচিতির কারণে প্রাণীটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে
ছবি: প্রথম আলো

পরিবেশের উপকারী প্রাণী, জাতে বিড়াল। প্রাণীটির নাম মেছো বিড়াল। যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা প্রাণীটিকে ‘মেছো বাঘ’ নামে চেনেন। এই বাঘ পরিচিতিই প্রাণীটিকে বিপদে ফেলেছে। মানুষ প্রাণীটিকে দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। প্রাণীটির প্রধান খাবার মাছ হলেও গৃহপালিত হাঁস-মুরগি খোয়া গেলেই মানুষ প্রাণীটির ওপর ক্ষোভ ঝাড়ে। কেউ কেউ ধাওয়া দিয়ে মেরে ফেলে। কেউ ফাঁদ পেতে খাঁচাবন্দী করছে।

মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওরের বাইক্কাবিলসহ বিভিন্ন বিল, গ্রামীণ ঝোপঝাড়, অগভীর জলাভূমি ও পাহাড়ি ছড়ায় মেছো বিড়ালের দেখা মেলে। পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণীটির অবদান গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাসস্থান সংকুচিত হওয়া ও মানুষের সচেতনতার অভাবে প্রাণীটির জীবন বিপন্ন করে তুলেছে।

এরই মধ্যে কাল শনিবার দেশে প্রথমবারের মতো নানা আয়োজনে বিশ্ব মেছো বিড়াল দিবস-২০২৫ উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘জনগণ যদি হয় সচেতন, মেছো বিড়াল হবে সংরক্ষণ।’

বন্য প্রাণী গবেষকেরা বলছেন, সারা বিশ্বে মেছো বিড়াল এখন সংকটাপন্ন প্রাণী। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর সংগঠন (আইইউসিএন) মেছো বিড়ালকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। প্রাণীটি বাংলাদেশেও বিপন্ন। প্রাকৃতিক জলাভূমি কমায় প্রাণীটির সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।

বন বিভাগ, বন্য প্রাণী–গবেষক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মেছো বিড়াল প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় উপকারী একটি প্রাণী। বিড়াল প্রজাতির এই প্রাণী নিশাচর। সচরাচর দেখা যায় না। দিনে ঝোপঝাড়, গাছের প্রশস্ত ডাল ও গর্তে ঘুমিয়ে কাটায়। রাতের বেলা জলাশয়ের আশপাশে বিচরণ করে। প্রধান খাবার মাছ। কোনো জলাভূমির আশপাশে মেছো বিড়াল থাকলে সেখানে মাছের পরিমাণ বাড়ে। এরা বেশির ভাগ সময় মরা ও রোগাক্রান্ত মাছ খেয়ে জলাশয়ে মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণ করে। মাছ ছাড়াও এরা জলাভূমির ইঁদুর, সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া ও পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে। জলাভূমির পাখি, খরগোশ, গুইসাপসহ মাঝারি আকারের অনেক জলজ প্রাণী শিকার করে। সাধারণত মেছো বিড়াল মানুষকে আক্রমণ করে না। উল্টো মানুষ দেখলে ভয়ে পালিয়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র মেছো বিড়াল বিচরণ করে। বিশেষ করে হাওর-বাঁওড়, বিল-পুকুর, পাহাড়ি ছড়া, গ্রামীণ ঝোপঝাড় ও জলাভূমির আশপাশে এদের বেশি দেখা যায়। হাওর ও জলাভূমি অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাউয়াদীঘি, হাইল হাওরের বাইক্কাবিলসহ বিভিন্ন বিল, গ্রামীণ ঝোপঝাড়, অগভীর জলাভূমি ও পাহাড়ি ছড়ার কাছে মেছো বিড়ালের বিস্তৃতি আছে। আবাস ও খাদ্যসংকটে পড়লে এই প্রাণী গ্রামের দিকে চলে আসে। মানুষের আক্রমণের ফলে প্রাণীটি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

মানুষের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ছে মেছো বিড়াল
ছবি: প্রথম আলো

বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, নানা কারণে দেশে গ্রামীণ ঝোপঝাড় কমে যাচ্ছে। ফলে মেছো বিড়ালের আবাসস্থল ধ্বংসের মুখে পড়েছে। দূষণসহ খাল-বিল অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভরাটের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে মাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এ জন্য খাবারের অভাবে মেছো বিড়াল মাঝেমধ্যে খামারিদের হাঁস-মুরগি কিংবা মাছের খামারে চলে আসছে। ফলে প্রতিনিয়ত মানুষ ও মেছো বিড়ালের সংঘাত বাড়ছে। কিছু কৌতূহলী খামারি ফাঁদ পেতে আটকও করছে। উৎসুক জনতা বাঘ মনে করে নিরীহ প্রাণীটিকে হত্যা করছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে প্রাণীটি আটকের খবর পেলে উদ্ধার করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে আবার প্রকৃতিতে অবমুক্তের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মেছো বিড়ালসহ বন্য প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করছে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।

মেছো বিড়াল আকারে গৃহপালিত বিড়ালের চেয়ে কিছুটা বড়। শরীর ঘন, পুরু লোমে আবৃত। গায়ের রং ধূসর, সঙ্গে বাদামি আভা আছে। পেটের নিচের রং সাদাটে। শরীরজুড়ে ছোপ ছোপ কালো দাগ। চোখের ওপর কপাল থেকে কানের দিকে কালো দুটি রেখা আছে। গাল দুটি হালকা সাদাটে। দাঁত বড়, কান গোলাকার ও অপেক্ষাকৃত ছোট।

বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী, মেছো বিড়াল ফাঁদ পেতে ধরা, হত্যা, পাচার কিংবা ক্রয়-বিক্রয় আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা। অথবা একসঙ্গে উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছর তুলনামূলকভাবে কম মেছো বিড়াল ধরা পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা শুধু মেছো বিড়াল নয়, পাখিসহ অন্যান্য প্রাণী নিয়ে বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময় করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।