শরীয়তপুরে আলোচিত পিপি হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু
দেড় যুগের বেশি সময় থমকে থাকার পর শরীয়তপুরের আলোচিত সাবেক পিপি ও আওয়ামী লীগ নেতা হাবীবুর রহমান হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার ওই হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত। শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শওকত হোসেনের আদালতে মামলার সাক্ষী ও হাবীবুর রহমানের ছেলে পারভেজ রহমানের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় আজ।
২০০১ সালের ৫ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় জেলা জজ আদালতের সাবেক রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেনকে। দীর্ঘ ১৯ বছর যাবৎ আটকে আছে আলোচিত ওই হত্যা মামলার বিচারকাজ। এ নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘১৯ বছর আটকে আছে বিচারকাজ, শঙ্কায় পরিবার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
আজ মামলার ৪৪ আসামি আদালতে উপস্থিত হন। আলোচিত ওই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হওয়ায় আদালত প্রাঙ্গণে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা।
হাবীবুর রহমান নিহত হওয়ার সময় আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর তাঁর ভাই মনির হোসেন ছিলেন পৌরসভা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ প্রয়াত হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আসামি করে মামলা হয়েছিল।
মামলার প্রধান আসামি আওরঙ্গ ছাড়াও ওই মামলার আসামি স্বপন কোতোয়াল ও শাহজাহান মাঝিও মৃত্যুবরণ করেন। আর চারজন চলে গেছেন দেশের বাইরে। বাকি আসামিরা রয়েছেন জামিনে।
মামলার এজাহার ও বাদীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জাজিরা উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন মামলার আসামি হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তখন আওরঙ্গের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ। সে সময় এ নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষ হতো দুই পক্ষের মধ্যে।
১ অক্টোবরের ওই নির্বাচনে জাজিরার কয়েকটি ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত হয়। ৭ অক্টোবর ওই সব কেন্দ্রের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের আগে ৫ অক্টোবর হাবীবুর রহমানের শহরের বাসভবনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে সভা চলছিল। ওই সভায় হামলা চালান আওরঙ্গের সমর্থক সাবেক যুবলীগ নেতা সরোয়ার হোসেন বাবুল তালুকদারের লোকজন। এ সময় বাবুল তালুকদারের ভাই মন্টু তালুকদার গুলিবিদ্ধ হন। এর প্রতিশোধ নিতে কিছু সময় পরেই ওই বাসভবনে পুনরায় হামলা করা হয়। তখন হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
আমাদের চোখের সামনে বাবা-চাচাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন আমরা শিশু ছিলাম। শিশু বয়স থেকেই বাবার হত্যার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। বিপদের মুহূর্তে অনেককেই পাশে পাইনি। হত্যাকারীরা আওয়ামী লীগে পুরস্কৃত হচ্ছে।পারভেজ রহমান, নিহত হাবীবুর রহমানের ছেলে
ওই ঘটনায় হাবীবুর রহমানের স্ত্রী, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জিন্নাত রহমান বাদী হয়ে আওরঙ্গকে প্রধান আসামি করে ৫৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ তদন্ত করে ওই মামলা থেকে আওরঙ্গের নাম বাদ দিয়ে ২০০৩ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করে। মামলার বাদী তখন আদালতে নারাজি দেন। আদালত ওই নারাজির আবেদন নামঞ্জুর করেন।
এরপর বাদী জিন্নাত হাবীব উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। ওই আবেদন নিষ্পত্তিও দীর্ঘায়িত হয়। বাদীপক্ষের অভিযোগ, সাবেক সাংসদ আওরঙ্গই প্রভাব খাটিয়ে তা দীর্ঘায়িত করেন। ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আওরঙ্গের মৃত্যু হয়। এরপর ওই বছরই উচ্চ আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দেন পুলিশকে। পুলিশ ওই বছর অক্টোবরে আদালতে ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। যদিও তদন্তে আওরঙ্গর ভূমিকা উঠে আসলেও তিনি মারা যাওয়ায় আসামির তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জানায় পুলিশ।
আওরঙ্গ ছাড়াও ওই মামলার আসামি স্বপন কোতোয়াল ও শাহজাহান মাঝিও মৃত্যুবরণ করেন। আর চারজন চলে গেছেন দেশের বাইরে। বাকি আসামিরা রয়েছেন জামিনে। অধিকাংশ আসামি এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। এ ছাড়া বাদী জিন্নাত হাবীবও ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট মারা যান। তাঁর ছেলে আইনজীবী পারভেজ রহমানই এখন মামলাটি এগিয়ে নিচ্ছেন।
পারভেজ রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে বাবা-চাচাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন আমরা শিশু ছিলাম। শিশু বয়স থেকেই বাবার হত্যার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। বিপদের মুহূর্তে অনেককেই পাশে পাইনি। হত্যাকারীরা আওয়ামী লীগে পুরস্কৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাশে না থাকলে হয়তো আমরাও হারিয়ে যেতাম। মামলায় সাক্ষী দিয়েছি। প্রার্থনা করছি, হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’
শরীয়তপুর জেলা জজ আদালতের পিপি মীর্জা হযরত আলী আজ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার প্রধান আসামি সাবেক সাংসদ হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ অনেক প্রভাব বিস্তার করেছেন। ২০১৩ সালে তিনি প্রয়াত হওয়ার পরই মামলার গতি ফিরে এসেছে। নানা আইনি জটিলতা কাটিয়ে এখন সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মাসুদুর রহমান প্রভাব বিস্তারের কথা নাকচ করে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বাদী-বিবাদীদের রিট করার কারণে মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হয়েছে। এখন সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে বোঝা যাবে, আমার মক্কেলরা আসলে কতটা জড়িত।’